রাজনীতি

বাজেটে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তরা উপেক্ষিত : ওয়ার্কার্স পার্টি

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রাথমিক পর্যালোচনায় ওয়ার্কার্স পার্টি বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটকে জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে প্রণীত হওয়ায় কথা বলা হলেও করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকা উভয়ই উপেক্ষিত।

Advertisement

করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে ভ্যাকসিন প্রধান অস্ত্র হলেও সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে তার প্রাপ্তি অনিশ্চিত। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী মাসে পঁচিশ লাখ ভ্যাকসিন দেয়া হলে ন্যূনতম চার বছর লাগবে সাধারণ মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে। ভারতের একমাত্র উৎস থেকে আমদানি করা ভ্যাকসিন দিয়ে গণটিকা কার্যক্রম সফলভাবে শুরু হলেও, ভ্যাকসিন নিয়ে বাণিজ্য, কূটনীতি ও রাজনীতির কারণে কবে সেই টিকা আসবে জানা নেই। সর্বশেষ চীন থেকে টিকা কেনা নিয়ে চুক্তির গোপন তথ্য সরকারি উচ্চ পর্যায় থেকে ফাঁস করে দেয়ার যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেটা আরও জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এটা যারা করেছে কেন করেছে তা জানা প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করার জন্য যেখানে সাংবাদিককে জেলে যেতে হয় সেখানে এ ধরনের গর্হিত কাজের জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা জাতিকে জানাতে হবে। তাছাড়া বাজেটে টিকাদানের কোনো রোডম্যাপ মন্ত্রী উল্লেখ করেননি বরং টিকা সরবরাহ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পূর্ণ বিপরীত।

অপরদিকে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্থ বরাদ্দ কিছুটা বৃদ্ধি হলেও, করোনায় গত এক বছরে যে আড়াই কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে দরিদ্র হয়ে পড়েছে তাদের জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। এই আড়াই কোটি দরিদ্র মানুষ বাজেটে পরিপূর্ণভাবে উপেক্ষিত। অর্থমন্ত্রী তার বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে নিজেই বাজেটকে ব্যবসা বান্ধব বলে দাবি করে বলেছেন যে ‘ব্যক্তিখাতকে ড্রাইভিং সিটে বসাতে হবে এবং ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ বাড়ার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান বাড়বে’।

সংবিধানে যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতকে প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে ব্যক্তিখাতকে ড্রাইভিং সিটে বসানোর কথা বলে মন্ত্রী সংবিধানের উল্টো কথাই বললেন। অথচ কোভিডকালে এমনকি পুঁজিবাদের নেতৃত্ব দানকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষকে দেয়ার জন্য বাজেটে দেড় ট্রিলিয়ন ডলারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী করোনার প্রথম বছরে পঞ্চাশ লাখ লোকের জন্য ২৫০০ টাকা করে যে সামান্য অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তার এক তৃতীয়াংশই অব্যয়িত থেকে গেছে। এবারও ঈদে তিনি ৩৫ লাখ লোককে আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন- যা ওই আড়াই কোটি মানুষের স্বল্পাংশ। সামাজিক নিরাপত্তার অর্থের এক অংশ সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন আর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা।

Advertisement

স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ সম্পর্কে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রস্তাবে বলা হয়, গত বছরের চাইতে কয়েক হাজার কোটি টাকা এ খাতের বরাদ্দ বৃদ্ধি পেলেও, তা সামগ্রিক জিডিপির ১ শতাংশের কিছু ওপরে, যা প্রতিবেশী নেপাল, ভারত, শ্রীলংকা এমনকি পাকিস্তানের চেয়েও কম। অর্থমন্ত্রী গত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতিকে মোটেই আমলে নেননি। কোভিডকালে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যে দুর্নীতি ও দুরবস্থা বেরিয়ে এসেছে তার থেকে উত্তরণের কোনো পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাজেটের ১৫.৪ শতাংশ বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ১১ শতাংশের কিছু ওপরে। প্রযুক্তি খাতকে যুক্ত করে এই বাড়তি বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। করোনা যেখানে শিক্ষার্থীদের সমগ্র শিক্ষাজীবন থেকে দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে সেখানে অনলাইন শিক্ষাসহ বিকল্প শিক্ষার জন্য যেসব প্রণোদনা দেয়া প্রয়োজন ছিল তা অনুপস্থিত বরঞ্চ বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নতুন করে করারোপ করা হয়েছে যা শিক্ষার বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অযৌক্তিক।

কৃষি ক্ষেত্রে বরাদ্দ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করলেও কৃষক সন্তুষ্ট নয়। কোভিডের দু’বছর পরপর বাম্পার ফলন ফলালেও কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ সেই পুরোনো ছকে বাধা। সরকার গত বছর লক্ষ্যমাত্রার বহু নিচে সংগ্রহ করতে পেরেছে। ফলে সরকারি গুদাম শূন্যের পর্যায়ে। খাদ্যশস্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়া হয়েছে সিন্ডিকেটের হাতে যার ফলশ্রুতিতে ফসলের ভরা মৌসুমে চালের দাম বেড়েই চলেছে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে।

কৃষি যান্ত্রিকীরণের সুবিধা ভোগ করছে বড় চাষী। এই বাজেটে পূর্ব প্রতিশ্রুত ২৪০টি উপজেলায় প্যাডিসাইলো প্রতিষ্ঠা, সমবায়ী পরিচালনা ব্যবস্থার কোনো কথা নেই। আর খেত মজুরদের পেনশনের প্রশ্নটি উপেক্ষিত। এমনকি ইউনিভার্সাল পেনশন স্কিম নিয়েও কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

Advertisement

করোনা প্রাথমিকভাবে শহরভিত্তিক থাকলেও এখন দ্বিতীয় ঢেউ গ্রামের দিকে বিস্তৃত হচ্ছে যা মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ইতোমধ্যে শহরে করোনা সংক্রমণে কাজ হারিয়ে মানুষ গ্রামে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ওপর চাপ পড়ছে। তার মোকাবিলার কৌশল বাজেটে নেই।

ওয়ার্কার্স পার্টির প্রস্তাবের সর্বশেষে বলা হয়, যে কোভিডকালে দুটি বাজেটে যেটা স্পষ্ট তা হলো- জনগণের জীবন ও জীবিকা নয়, ক্ষমতার বলয়ে অতি ধনী-সামরিক-বেসামরিক আমলার, যে শক্ত আঁতাত গড়ে উঠেছে তাদের স্বার্থরক্ষায় বাজেটে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট পর্যালোচনা সভায় ও তার ভিত্তিতে গৃহীত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, পলিটব্যুরো সদস্য আনিসুর রহমান মল্লিক, মাহমুদুল হাসান মানিক, নুর আহমেদ বকুল, কামরূল আহসান, আমিনুল ইসলাম গোলাপ, নজরুল ইসলাম হক্কানী, আলী আহমেদ এনামুল হক এমরান প্রমুখ।

এমইউ/এমআরআর/এমকেএইচ