প্যারিস থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া। আবার গণহত্যা। এবার প্রতিবন্ধী সেবাকেন্দ্রে ঢুকে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়েছে কয়েকজন বন্দুকধারী। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ১৪ জন মারা গেছে, মৃত্যুর সাথে লড়ছে ১৭ জন। পুলিশের অভিযানে গুলিতে দুই বন্দুকধারী নিহত হয়। হামলার সময় পুলিশের অভিযানে নিহত দুই বন্দুকধারীই মুসলিম। তাদের মধ্যে একজন মার্কিন বংশোদ্ভূত। তারা হলেন, সৈয়দ রিজওয়ান ফারুক (২৮) ও তাসফিন মালিক (২৭)। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টার দিকে সান বার্নার্ডিনো কাউন্টির ইনল্যান্ড রিজিওনাল সেন্টার নামের ওই সেবাকেন্দ্রে এ হামলার ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনা এখন আর কাউকে বিস্মিত করে না। সংবাদ সম্মেলন করে কাউন্সিল অব আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্স এর নেতারা বলেছেন, এমন ঘটনায় তাদের মাথা হেট হয়ে গেছে, তারা অস্বস্তি বোধ করছেন, তারা নিন্দার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে এখনো নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না এটি জঙ্গি হামলা কিনা। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওঁলাদ বলেছেন, পুরো দেশ এখন যুদ্ধের মধ্যে আছে। এবং ফ্রান্সসহ বিশ্বব্যাপী শোকের মাঝেই ফ্রেঞ্চ যুদ্ধ বিমান সিরিয়ায় বোমা ফেলতে শুরু করেছে যা এখনো অব্যাহত আছে। এদিকে সিরিয়ায় জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালানোর প্রস্তাব অনুমোদন করেছে বৃটিশ পার্লামেন্ট। বুধবার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব অনুমোদন করে। সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন চলমান বিমান হামলায় যুক্তরাজ্যের অংশগ্রহণ করার প্রশ্নে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে ১০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তুমুল বিতর্ক চলে। এরপর প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের ওই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হয়। আইনপ্রণেতারা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। প্রস্তাবের পক্ষে ৩৯৭টি এবং বিপক্ষে ২২৩টি ভোট পড়েছে। ভোটাভুটির কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে যুক্তরাজ্যের চারটি যুদ্ধবিমান সাইপ্রাসের বিমানঘাঁটি থেকে আকাশে ওড়ে।আইএস-এর সন্ত্রাস ভয়ংকর। মগজ ধোলাইয়ের শিকার এসব আত্মঘাতী সন্ত্রাসী শুধু জানে খুন করতে হবে, কাকে করছে, কেন করছে তা তারা জানে না। তবে পশ্চিমা নেতৃত্বকে ভাবতে হবে শুধু বোমা মেরে আইএস নামের এমন দানবকে দমানো যাবে কিনা? রাজনীতিকরা সন্ত্রাসের জবাব বোমা দিয়ে দেয়ার অনুমতি দিলেও ইউরোপের সুশীল সমাজ বলছে, বিকল্প কিছু ভাবতেই হবে। ইউরোপ জুড়ে একটিই কথা, নাইন ইলেভেন থেকে আমেরিকা যা শিখেছে, তার চেয়ে বেশি কিছু করতে হবে ইউরোপকে। কিন্তু সেই করা মানে দেশ দখল, বোমা মারা কিনা, কিংবা আমেরিকার মতো ইউরোপও কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করবে কিনা তা নিয়ে ভাবনার সময় এখন। আইএসকে যারাই আঘাত করে পাল্টা আঘাতে তারা নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। রাশিয়া আইএস লক্ষ্যবস্তুতে বোমা ফেলেছে, আইএস শার্ম আল শেখ-এ বোমা মেরে প্লেন উড়িয়ে দিয়েছে, যেভাবে তারা হামলা করেছে প্যারিসে, হামলা করেছে বৈরুতে।আইএস, তালেবান, আল-কায়েদা, নুসরা ফ্রন্ট বা বোকো হারামের মতো সংগঠনের একমাত্র অস্ত্র সন্ত্রাস আর সহিংসতা। সবগুলো শক্তিধর দেশগুলো এতসব বোমা মেরেও বাগে আনতে পারছে না আইএসকে। আইএস বড় কোনো জয় কোনোদিন পাবে না, কিন্তু এমন ত্রাস তারা জিইয়ে রাখবে বহুদিন। সিঙ্গাপুর ন্যানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কুমার রামাকৃষ্ণ বলছেন, আইএস জানে সে পারবে না এসব দেশের সাথে, কিন্তু তাদের সন্ত্রস্ত রাখা যাবে, আর এই হুমকি মোকাবেলায় বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে এই দেশগুলোকে। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে গণতন্ত্র আর মানবাধিকার নিশ্চিত করতে গিয়ে আমেরিকা হামলা করেছে, সরকারগুলোর পতন হয়েছে, কিন্তু এসব দেশে শৃংখলা এসেছে কী? এক নায়ক গাদ্দাফির সময়ে লিবিয়ায় একটি সরকার ছিল, লেখাপড়া ছিল, স্বাস্থ্যসেবা ছিল, কিন্তু এখন কি আছে? দেশটি কার্যত এখন বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠির সন্ত্রাসীদের দখলে। মানুষের জান-মালের সামান্যতম নিশ্চয়তা নেই সেখানে। একই অবস্থা ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তানে। তাই হিসেবের খাতা খুলছে পশ্চিমা নাগরিকরা। এসব গণতন্ত্রের অভিযানে তাদের দেশগুলো আজ ভরে যাচ্ছে ইরাক সিরিয়ার শরণার্থীতে, তাদের দেশের খরচ বাড়ছে সন্ত্রাস মোকাবেলায় আর প্রতিনিয়ত থাকতে হচ্ছে উদ্বেগের মধ্যে। সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার সম্প্রতি বলেছেন, গোয়েন্দাদের ভুল তথ্যের ভিত্তিতে ইরাক আক্রমণ করা হয়েছিল আর এ জন্য তিনি দুঃখিত। একটি দেশকে চিরদিনের জন্য অস্থিতিশীল করে দিয়ে শুথু দুঃখ প্রকাশ! প্রায় একই রকম কথা বলেছেন সাবেক মার্কিন জেনারেল মাইকেল ফ্লিন যিনি আ্ফগানিস্তান এবং ইরাকে মার্কিন বিশেষ বাহিনী এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা অধিদপ্তরের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনিও বলেছেন ইরাক আক্রমণ এবং সাদ্দাম হোসেনের উৎখাত ছিল “বড় ধরনের ভুল”।ইরাক আক্রমণ যদি ভুল হয়, তাহলে এখন যা হচ্ছে তা কি ঠিক? পশ্চিমা দুনিয়ার বাইরে প্রচারণাটা অনেক জোরালো যে আল-কায়েদা বা তালেবান যেমন আমেরিকার সৃষ্টি, আইএসও স্রষ্টি করেছে তারাই। আজ আমেরিকা নিজে এই সৃষ্টির যন্ত্রণায় ভুগছে, তার সাথে ভুগছে সারা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ। সিরিয়া কিভাবে চলবে, বা বাংলাদেশের কেমনভাবে চলা দরকার তা স্ব স্ব দেশের উপর না ছেড়ে সবকিছুতে নাক ডুবালে এমন আইএস তৈরি হতেই থাকবে। মানুষের জীবন যাচ্ছে, নিরীহ পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছে যেমনটা হয়েছে প্যারিসে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি আর্থিক মূল্য দিতে হচ্ছে এ বিশ্বকে। একটির পর একটি নতুন ফ্রন্ট খুলছে। বিশ্বব্যাপী এখন মানুষের সাথে লড়ছে অসংখ্য মানুষ এবং সামনে এই লড়াই আরো বাড়বে যেমনটা বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাহলে কি করতে হবে? ন্যাটোর সাবেক সুপ্রিম কমান্ডার আ্যাডমিরাল জিম স্টাভরিডিস বলছেন, বোমা কোনো সমাধান নয়। তার মতে বৃহত্তর ঐক্যের যে সুর উঠেছে তার দিকে নজর দিয়ে আমেরিকা, রাশিয়া ও ইরানের ঐক্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। ইরান বিরোধিতা ছেড়ে সৌদি আরবকেও এগিয়ে আসতে হবে এই ছাতার নিচে এবং ওহাবি মতবাদের প্রচার বন্ধ করতে হবে যে মতবাদ শুধু অন্য ধর্ম, এমনকি মুসলমানদের বিভিন্ন উপ-গোত্রগুলোকেও কেবল ঘৃণা করতে শেখায়। তিনি আরো বলছেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ে যে ঐক্যমত পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে তা এগিয়ে নিতে দেশটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হবে, প্যালেস্টাইন সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের দিকে নজর দিতে হবে, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের কি হবে তা নিয়ে সুর নরম করতে হবে পশ্চিমা বিশ্বকে এবং সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামাতে আইএস বিরোধী সর্বোচ্চ প্রচারণা জোরদার করতে হবে।মানুষকে সাথে না নিয়ে শুধু অস্ত্রের বদলে অস্ত্র, হত্যার বদলে বোমা সমাধান দিবে না। এইচআর/এমএস
Advertisement