মন্টু মিয়ার বয়স ষাট। পিঞ্জিরা বেগমও পঞ্চান্ন পেরিয়েছেন। সংসার জীবনে তাদের ঘর আলো করে এসেছিল পাঁচ সন্তান। ছেলে-মেয়েদের অনেক কষ্টে লালন-পালন করে বড় করেছেন তারা। বড় হয়ে তিন ছেলে বিয়ে করে গড়েছেন আলাদা সংসার। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখন সন্তানরা আলাদা থাকায় বুড়ো বয়সে অসহায় হয় পড়েছেন মন্টু মিয়া ও পিঞ্জিরা বেগম। তবে বৃদ্ধ বয়সে শেষ সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে ছোট্ট ছেলে শাওন (৯)।
Advertisement
রাজশাহীর চারঘাট পৌর এলাকার মেরামতপুর গ্রামের বাসিন্দা মন্টু মিয়া। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছেন। কাজ করতে পারেন না মোটেই। তাই শিশু শাওন ধরেছে সংসারের হাল। ভ্যান চালিয়ে করছেন উপার্জন, দেখভাল করছেন অসুস্থ বাবা-মাকে। যেন পুরো সংসারের যোগান এখন শিশু শাওনের (৯) কাঁধে।
শাওনের মা পিঞ্জিরা বেগম জানায়, শাওনের বাবা মন্টু মিয়া বয়সের ভারে বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় কোনো প্রকার কাজ-কর্ম করতে পারছেন না।
এদিকে প্রায় দেড় বছরের মতো সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকায় স্কুলেও যাওয়া হয় না শাওনের। তাই দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের ব্যবস্থা করতে রাস্তায় ভ্যান নিয়ে নামতে হয়েছে শিশু শাওনকে। শাওন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চারঘাটের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে এখন ব্যস্ত।
Advertisement
তার মা আরও জানান, বাবার ওষুধের টাকা ও সংসারের খরচ যোগাতে সকাল-দুপুর এমনকি রাতেও রাস্তায় রাস্তায় ভ্যান চালায় শাওন। অনেক দিন খাবার সময় পেরিয়ে গেলেও বাড়িতে ফেরে না। খাবার নিয়ে পথ চেয়েও তার পাত্তা পাওয়া যায় না।
পিঞ্জিরা জানান, ‘রাস্তা-ঘাটে আমাদের খাবারের জন্য ভ্যান চালায় আমার ছেলেটি। আজ বাপ ভালো থাকলে কি আর তাকে ভ্যান চালানো লাগত? রাস্তায় ভ্যান চালায় আমার ছোট ছেলে, এ কারণে মাঝে মাঝে খুব ভয় হয়।
ছোট মানুষ, কখন কোথায় দুর্ঘটনা ঘটে বলা যায় না। এই বয়সে তার স্কুল করার কথা। বই খাতা নিয়ে পড়ার কথা, কিন্তু সে সংসার চালাতে রাস্তায় রাস্তায় ভ্যান চালাচ্ছে। অথচ, তার বড় ভাই-বোনেরা একবারও আমাদের খোঁজ-খবর নেয় না।
এদিকে শাওন জানায়, সে পিরোজপুর-১ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। তার স্কুলের শিক্ষকেরা জানান, লেখাপড়ায় বেশ মনোযোগী শাওন। সকল শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রও সে। তবে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় ও বয়স্ক বাবা অসুস্থতার কারণে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাচ্ছে শাওন।
Advertisement
শাওনের বাবা মন্টু মিয়া বলেন, ‘বয়সের কারণে আমি চলতে ফিরতে পারি না। ব্যাটা ভ্যান চালালে আমাদের দু’বেলা খাবার জোটে। কি আর করার, ব্যাটা ভ্যান না চলালেও তো হয় না। একদিন ভ্যান চলালে পরদিন চলাতে পারে না। স্কুল বন্ধ তাই সে পড়া বাদ দিয়ে রাস্তায় ভ্যান চালাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার ছোট ব্যাটা শাওন বাইরে ভ্যান চালাতে গেলে মা টেনশন করে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ছেলে বাড়িতে ফিরলে মা-ছেলে দু’জনে মিলে খাবার খায়, গল্প হয় নানান বিষয় নিয়ে।’
ছেলের ভ্যান চালানোর ভীতি নিয়ে শানওনের মায়ের দাবি, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অথবা কোনে বিত্তবান লোক যদি পাশে দাঁড়াত তাহলে আমাদের দুঃখ অনেকটা লাঘব হত। সরকারের পক্ষ থেকে যদি কেউ আমাদের সহায়তায় করত, তাহলেও অসুস্থ স্বামীর চিকিৎসা করিয়ে পুনরায় আমাদের সংসারটি ঘুরে দাঁড়াত। এমনকি আমার ছোট ছেলে শাওনও পড়াশোনায় মনোযোগী হতে পারত।
ফয়সাল আহমেদ/এমআরএম/এমকেএইচ