কেন্দ্রীয় সম্মেলনের সাড়ে চার মাস পর অবশেষে গঠিত হচ্ছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি। আগামী ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের আগেই এ কমিটি ঘোষণা করা হবে। ইতোমধ্যে কমিটি গঠনও চূড়ান্ত করা হয়েছে। জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ।ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, সব ধরণের সিন্ডিকেট মুক্ত, নিয়মিত ছাত্র, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী এবং সংগঠনের প্রতি আনুগত্যশীলদের নিয়েই গঠন করা হবে এ কমিটি। ইতোপূর্বে যারা সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরণের অপরাধের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছেন তাদের কমিটিতে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি। এমনকি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনেও বয়সসীমাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তাই সাংগঠনিক নিয়মানুযায়ী ২৯ বছর থেকে কারো বয়স ১ দিনও বেশি হলে তাকে কমিটিতে না রাখারই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এ ছাত্র সংগঠনটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ছাত্রলীগকে নিয়মিত ছাত্রদের হাতে তুলে দিতেই এমনটি করা হচ্ছে।তবে বাস্তব নমুনা কিছুটা ভিন্ন। সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত, নির্দিষ্ট বয়সসীমার অতিরিক্ত বয়সের নেতা, চাটুকার এবং ৫ জানুয়ারির আগে যাদের রাজপথে দেখা যায়নি এমন নেতারাই পদ প্রাপ্তির দৌঁড়ে এগিয়ে। আর কমিটি গঠন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন সাবেক নেতারা।জানা গেছে, মহান বিজয় দিবসের আগেই কমিটি ঘোষণা করা হবে। সেক্ষেত্রে চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে এটি হতে পারে। তা সম্ভব না হলে আগামী সপ্তাহের প্রথম দিকে এটি ঘোষণা করা হবে। এর আগে কয়েক দফা কমিটি গঠনের কথা বলেও ব্যর্থ হয়েছেন সংগঠনের সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন। তবে এবার আর বিলম্ব করার কোনো কারণ নেই বলেও জানা গেছে সংগঠনের আরেক দায়িত্বশীল সূত্রে।সূত্র জানায়, ইতোপূর্বে কয়েক দফায় খসড়া কমিটি গঠন করা হলেও বিভিন্ন কারণে তা ভেস্তে গেছে। বিশেষ করে সংগঠনের সাবেক নেতাদের হস্তক্ষেপই ছিল তার অন্যতম কারণ। এমনকি সরকারের বর্তমান কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি এবং আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার হিসেব মেলাতে হচ্ছে সোহাগ-জাকিরকে। তাদের মনঃপুত না হওয়ায় বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হন। তবে এবার সব দিক ঠিক করেই কমিটি গঠন প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর আগে গত ৫ থেকে ১০ অক্টোবর পদ প্রত্যাশীদের জীবন বৃত্তান্ত নেয়া হয়েছে। তারপর এগুলো যাচাই বাচাই শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটি।ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় কাউন্সিলের ঘোষণা আসার পর থেকেই পদ প্রত্যাশী নেতা-কর্মীরা শুরু করেন নিজেদের লবিং-তদবির। সেক্ষেত্রে সাবেক নেতাদের দ্বারা গঠিত প্রভাবশালী দুটি সিন্ডিকেট মেন্টিং করা থেকে শুরু করে রাত-দিন ধর্ণা দিয়েছেন সাবেক নেতাদের বাসাতেও। স্থান পেয়েছিল অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতিও। সর্বশেষ লিয়াকত শিকদার সিন্ডিকেটের মনোনীত ব্যক্তিরাই জয়ী হয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদে। তবুও হাল ছাড়েননি এসব পদে জয়ী হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে থাকা অন্য প্রার্থীরা। সে সময় কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচনে ঊর্ধ্বতন নেতাদের চাপে নিজেদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেন এসব নেতারা। প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করলে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও স্থান পাবে না বলে কয়েকজন প্রার্থীকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। তাই সিন্ডিকেট নেতাদের পরামর্শে এখন চলছে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কাঙ্ক্ষিত পদ পাওয়ার লড়াই। আবার যারা বয়স জটিলতায় বাদ পড়েছেন তারাও চাচ্ছেন এখন নিজেদের পছন্দের লোকদের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে অর্ন্তভুক্ত করতে।এদিকে, সাবেক সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক রিপন-রোটন সিন্ডিকেটে থাকা নেতারা রয়েছেন এখনো ধোঁয়াশার মাঝে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো পাবে কি না এমন শঙ্কায় রয়েছেন তারা। সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অনুসারী ত্রাণকর্তাদের প্রতিও রয়েছে ক্ষোভ। নতুন কমিটিতে সভাপতি পদে লড়াই করতে গিয়ে সর্বশেষ বাধ্য হয়ে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করা সংগঠনের সাবেক কমিটির উপ-সম্পাদক পদের এক নেতা নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘তিনি পারবে না এটা তাহলে আমাকে আরো আগে জানিয়ে দিলেই পারতেন। তাহলে আমি অন্যভাবে রাজনীতি করতাম। দীর্ঘদিন যাবৎ তার রাজনীতি করে এখন কিছুই পাইনি।’এছাড়া গত কমিটির সম্পাদক পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘ভাইয়ের আশায় রাজনীতি করেছিলাম। কিন্তু শেষে যে অবস্থা দেখলাম তাতে কিছু বলার নেই। রাজনীতিতে এখন আর মেধা ও কোয়ালিটির মূল্যায়ন নেই। এখন মূল্যায়ন আছে বাটপারির।’অন্যদিকে, নতুনভাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেতে জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় হল ও বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা। ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মধুর ক্যান্টিন, টিএসসি, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, সোহাগ-জাকিরের বাসার নিচে। নিজেকে নেতার অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিতেই তাদের এ ব্যস্ততা। আবার রীতিমতো হাজির হচ্ছেন তথা কথিত সিন্ডিকেট নেতাদের বাসায়। কারণ জায়গা মতো লবিং-তদবির করতে না পারলে জুটবে না কাঙ্ক্ষিত পদটি। এ ধারণাই তাড়া করে বেড়াচ্ছে পদ-প্রত্যাশী নেতা-কর্মীদের মধ্যে। যার দরুণ স্বস্তি নেই তাদের মাঝেও। তাই সংগঠনের সাবেক নেতা লিয়াকত শিকদারের বাসায়ও সমানভাবে সময় দিচ্ছেন তারা। সঙ্গে সঙ্গে বদিউজ্জামান সোহাগ, মাহমুদুল হাসান রিপন, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন এবং সিদ্দিকী নাজমুল আলমের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন তারা।এদিকে, অভিযোগ উঠেছে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে এসমস্ত সিন্ডিকেটের ইশারায় স্থান পাবে নানা সময়ে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত নেতারা। তাছাড়া টাকা খেয়ে কমিটিতে স্থান দেয়ার পায়তারাও চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ প্রত্যাশী ও সাবেক কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।অন্যদিকে যাদের বয়স ২৯ বছর পার হয়নি, মেধাবী এবং সংগঠনের প্রতি অনুগত এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে বলে দাবি করা হলেও বাস্তব নমুনা ভিন্ন। সূত্র জানায়, সিন্ডিকেটের খপ্পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পাওয়ার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে হত্যা মামলার আসামি, প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া ব্যক্তি, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, ভর্তি পরীক্ষাসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসকারী নেতারাই। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ম্যানেজ করতে মোটা অংকের টাকা লেনদেনেরও অভিযোগ বিভিন্নস্তরের নেতাদের বিরুদ্ধে।এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘উইথ ভাই’ বিষয়টিও প্রাধান্য পাবে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে। ‘উইথ ভাই’ চক্র কাজ করছে বিভিন্ন দলীয় প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়ে নিজেদের ছবি বর্তমান ও সদ্য বিদায়ী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে ট্যাগ করে দেয়ার মাধ্যমে। এমনকি এসব নেতাদের নামে বিভিন্ন ধরণের কবিতা ও উপমা ব্যবহার চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ চক্রটি নিয়মিত প্রোগ্রামে হাজির না থাকলেও তৎপর রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। যদিও এদের বেশ কিছু অংশকে পাঁচ জানুয়ারির আগে রাজপথে পাওয়া যায়নি।অন্যদিকে, ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের পদ পেতে হলে তাকে অবশ্যই নিয়মিত ছাত্র, অবিবাহিত এবং বয়স হতে হবে ২৯ বছরের মধ্যে। কিন্তু পদ পাওয়ার দৌঁড়ে অছাত্র, বিবাহিত এবং ২৯ বছরের বেশি বয়সীরাই এগিয়ে রয়েছে। আবার এদের এসব বিষয় আড়াল করারও চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া সংগঠনটির দুুর্দিনে যাদের পাশে পাওয়া যায়নি তারাই বেশি তৎপর এখন। যার ফলে ক্ষোভে ফুঁসছেন ত্যাগী নেতারা।নাম প্রকাশ না করা শর্তে গত কমিটির সহ-সম্পাদক পদের এক নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট থেকে বের না হয়ে আসলে যোগ্য নেতৃত্ব কখনো বের হয়ে আসবে না। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে ছাত্রলীগ। হয়তোবা কিছু লোক কিছু দিন স্বস্তিতে থাকবেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এরা কোনো কাজে আসবে না। একদিন এ সংগঠনের ক্ষতি করতেও এদের বাধবে না। তাই আমি মনে করি যোগ্যতা ও দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী নেতাদের দ্বারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হোক। যাতে সিন্ডিকেটের কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না।’জানতে চাইলে ছাত্রলীগ সভাপতি মো. সাইফুর রহমান সোহাগ জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৬ ডিসেম্বরের আগেই ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। ইতোপূর্বে কোনো ধরণের অপরাধের সঙ্গে জড়িত এমন কেউ কমিটিতে স্থান পাবে না। তাছাড়া যাদের বয়স ২৯ বছরের চেয়ে ১ দিনও বেশি হবে তারা এ কমিটিতে স্থান পাবে না। ছাত্রলীগ যেহেতু ছাত্রদের সংগঠন সেহেতু অছাত্ররা সার্টিফিকেট নকল করে কমিটিতে ঢুকতে পারবে না।’উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহ-সভাপতি ৪১ জন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ১০ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ১০ জন এবং বিভিন্ন সম্পাদক, উপ-সম্পাদকসহ মোট ২৫১ সদস্য বিশিষ্ট সদস্যের দ্বারা পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের নিয়ম রয়েছে। এমএইচ/একে
Advertisement