প্রবাস

দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে?

সম্প্রতি অপহরণকারীদের তিনবারের চেষ্টায় তুলে নেয়ার পথে ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছেন বাংলাদেশ যুবলীগের দক্ষিণ আফ্রিকা শাখার পদত্যাগকারী প্রচার সম্পাদক সাঈদুল হক (৩২)। বেঁচে ফিরলেও মারধর ও চলন্তগাড়ি থেকে সড়কে গড়িয়ে পড়ার কারণে গুরুতর আহত হন তিনি।

Advertisement

পরবর্তীতে দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়েছেন সাঈদুল হক। সেই ঘটনায় পুলিশ ও ভিকটিমের একটি দায়ের করাসহ দুইটি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধমূলক তৎপরতার কারণে সতর্কতা অবলম্বনমূলক দেশটিতে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের অধিকাংশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে লোকালয় এড়িয়ে চলে। অধিকাংশই জানাশোনার বাইরে মানুষদের সঙ্গে মিশতে উৎসাহ দেখায় না।

যুবলীগ নেতা সাঈদুল হকের মতো বছরের পর বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় বহু প্রবাসী বাংলাদেশি অপহরণের শিকার হচ্ছেন। অপহরণকারীদের চাহিদা মতো মুক্তিপণ দিয়ে বেশির ভাগ ভিকটিম ফিরতে পারলেও যারা মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয় তাদের খুন করে জঙ্গলে মরদেহ ফেলে দেয়া হয়। কাউকে চিরদিনের জন্য গুমও করে দেয়া হয় বলে জানান প্রবাসীরা।

তথ্য মতে, সর্বশেষ যুবলীগ নেতা সাইদুল হক (৩২) অপহরণের ঘটনাসহ দেশটিতে বিভিন্ন সময় প্রবাসীরা অপহরণের শিকার হয়ে শতাধিক ব্যক্তি মামলা দায়ের করেছেন। কিন্তু মাত্র একটি মামলায় বিচারকার্য চলা অবস্থায় অভিযুক্তদের আটক করে কারাবন্দি হতে দেখা গেছে। সেই ঘটনায় দুইজন কারাগারে রোগে-ভোগে মারা গেছে। ওই মামলায় চার অভিযুক্তের মধ্যে তিনজনই বাংলাদেশি।

Advertisement

দেশটিতে এত অপহরণের ঘটনা ঘটে চলেও ভুক্তভোগী প্রবাসীরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে শেষ পর্যন্ত বিচার প্রক্রিয়া চালিয়ে নিতে পারে না। যার কারণে বিচার বা ক্ষতিপূরণ কোনো কিছু পান না। আবার ভুক্তভোগীদের অনেকই ঘটনা নিয়ে আইনি পদক্ষেপ থেকে দূরে থাক, কথা বলতেই চায় না।

বিষয়টি নিয়ে অপহরণ থেকে মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখানে আমিসহ বেশিভাগ মানুষ একা থাকেন। যত বড় বিপদই আসুক না কেন পরিস্থিতি যাই হোক তার সাহস, শক্তি, অর্থ দিয়ে একাই মোকাবিলা করতে হয়। আর যদি মহাবিপদ অপহরণকারীর চক্রের নিশানা হয়ে যায় তাহলে তো রক্ষা নাই।

তিনি জানান, অপহরণকারীদের হাত থেকে বেঁচে ফিরলেনও গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। ব্যবসা বা চাকরি করার স্বাধীনতাটুকুও থাকছে না। নষ্ট হয়ে যায়। মামলা করলে বাড়তি অর্থ ও সময়ের দরকার হয়। একদিকে অর্থ উপার্জনের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

সে কারণেই মামলায় শেষ পর্যন্ত চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয় না। এটা এখানে নিয়মিত বিষয় হয়ে গেছে। এসব কারণে আইনি পদক্ষেপ নেয়া লোকজন হাতেগোনা। নিলেও সেটা একাকি, সীমিত আয় দিয়ে দীর্ঘসময় মাফিয়াদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার সাহস, সামর্থ্য নিয়ে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত চালিয়ে নিতে পারছে।

Advertisement

পরবর্তীতে মামলার পেছনে সময় ব্যয় করতে না পারায় এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অভিযুক্তরা জামিন নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ভিকটিমদের শেষ পর্যন্ত এসব ঘটনায় আর বিচার বা ক্ষতিপূরণ পাওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।

দেশটিতে বহু বাংলাদেশির সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সংগঠনের বাইরেও বড় শহরকেন্দ্রিক অঞ্চলভিত্তিক অনেকগুলো সংগঠন থাকলেও প্রবাসীদের বিপদের সময়ে খুব কম ব্যক্তি, সংগঠন ভিকটিমের সাহায্যে এগিয়ে আসে। অনেক ব্যক্তি সংগঠন আছে যারা লোভ দেখানো প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ায়। কার্যত তারা ঘটনা থেকে অর্থ ও রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে তৎপর বলে অভিযোগ প্রবাসীদের।

জোহানেসবার্গের নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে অপহরণকারীরা মারধর করে তুলে নেয়ার পথে গাড়ি থেকে ঝাঁপিয়ে আহত হয়ে প্রাণে বেঁচে ফেরেন সাইদুল হক

প্রবাসীরা হতাশ কণ্ঠে অভিযোগ করে বলেন, আবার ওইসব সংগঠনের মধ্যে কিছু লোক আছে যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের বিস্তর অভিযোগ। সংগঠন, দল, পদ ব্যবহার করে তারা নিজেদের অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা আইনি পদক্ষেপ নেয়াটা হিতে বিপরীত ফল হচ্ছে অনেক সময়।

প্রবাসীরা অভিযোগ তুলে আরও বলেন, ভিকটমকে সাহস ও আইনি সহায়তা দেয়ার চেয়ে বরং অপরাধ ধামাচাপা আর অপরাধীকে নীরবে নিষ্পাপ করে তোলাই সেসব নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকা পালন করে বেশি।

প্রবাসীরা জানান, দক্ষিণ আফ্রিকায় যেসব বাংলাদেশি অপহরণ, গুম ও খুনের শিকার হয়েছে তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাফিয়ারা জড়িত আর সেসব ঘটনার পেছনের ব্যক্তিদের বেশিরভাগই বাংলাদেশি।

জোহানেসবার্গে বসবাস করছে এমন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এখানে স্থানীয় অপরাধী সিন্ডিকেটের সঙ্গে মিলে তাদের ব্যবহার করে শুধু বাংলাদেশি নিরীহ প্রবাসীদের সঙ্গে ফৌজদারি অপরাধ সংঘঠিত করে আসছে। কিন্তু কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। শাস্তি পেতে হচ্ছে না। এ রকম অনেক বাংলাদেশি অপরাধমনস্ক মানুষ আছে।

তিনি আরও বলেন, তারা কমিউনিটির সঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ সেজে চলাফেরা করছে। কিন্তু তাদের আয়ের উৎস প্রবাসীদের সন্ত্রাসীদের দিয়ে তুলে এনে মারধর করে টাকা আদায় করা। টাকা না পেলে মেরে গুম করে দেয়। দোকান দখল করে দেয়া। প্রবাসী মাদকাসক্ত, উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করে লোকজনকে মারধর, হুমকি ধমকি প্রদর্শন করা।

চোখের সামনে এসব চলে আসলেও শক্তহাতে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন আইনি পদক্ষেপ না নেয়ায় বছরের পর বছর খুন, অপহরণ, গুম করে দেয়ার মতো অপরাধ করেও অবাধে পার পেয়ে যাচ্ছেন। আর একের পর এক নতুন নতুন মানুষকে তারা টার্গেটে বানিয়ে শিকার করে যাচ্ছে বলেন তিনি।

প্রবাসীদের এমন করুণ পরিণতিতে কী করা উচিত জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দক্ষিণ আফ্রিকা শাখা সভাপতি ডাক্তার রূপম রহমান বলেন, দেশটিতে অবস্থানরত সকল রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক সংগঠন ও হাইকমিশনের প্রতিনিধিদের নিয়ে একসঙ্গে বসে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশিদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করতে দেশটির স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা নিয়ে প্রবাসীদের সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে।

এমআরএম/এএসএম