চিকিৎসাসেবা একটি অনন্য শিল্প। একে প্রায়োগিকভাবে রপ্ত করতে হয়। জানতে হয় বিস্তর। আত্মস্থ করতে হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে। সব কাজের মধ্যে যেমন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণি আছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যেও তাই। সবকিছু ছাপিয়ে চিকিৎসকের উত্তম ব্যবহার, হাতের যশ, রোগ নির্ণয়, তার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগ, চিকিৎসার অনাবিল মুন্সিয়ানা হয়ে উঠে সোনালি। অনেক চিকিৎসক আছেন যাদের কোনো আবেগ ও হৃদয়ের ভাবাবেগ থাকে না। এ যেন রোবটিক ফাঁপা, নিষ্প্রাণ চিকিৎসার জন্য চিকিৎসা করা। এ রকম চিকিৎসকদের সাধারণ মানুষ মোটেই পছন্দ করেন না। চিকিৎসা করতে হয় রোগের ধরন বুঝে আর বাস্তবতা দিয়ে। তাহলেই রোগ দূরীভূত হবে।
Advertisement
পাঠক, আজ আপনাদের করোনাকালের এক হৃদয়বান চিকিৎসকের গল্প শোনাব। করোনার প্রথম দিকে যখন স্তব্ধ পুরো পৃথিবী। চারদিকে মানুষের পলায়নপর অবস্থা। ঘরবন্দি মানুষ। করোনা আতঙ্ক, উৎকণ্ঠা। গণমানুষের অভিযোগ, এমন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না সাধারণ রোগীও, এমন অহরহ অজস্র উদাহরণ রয়েছে।
সারাদেশের মতো অযাচিত এই পরিস্থিতির কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও। কিন্তু চট্টগ্রামকে কিছু মানবিক চিকিৎসক আগলে রেখেছেন, এই দুঃসময়ে দুর্যোগেও জীবনের অন্তিম ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসাসেবায় নিজেদের বিভোর রেখেছেন।
শোনাব একজন মানবিক চিকিৎসকের কথা, তিনি চট্টগ্রামের চিকনদন্ডী এলাকার মোহাম্মদ ইসহাক ও সেলিনা আকতারের জ্যেষ্ঠ পুত্র ডা. এম ওয়াই এফ পারভেজ।
Advertisement
করোনা অতিমারিতে যেখানে অধিকাংশ চিকিৎসক পলায়নপর ভূমিকায় ছিলেন, সেখানে ফ্রন্টলাইনার হিসেবে প্রথম থেকেই নিয়মিত রোগী দেখেছেন। আমানবাজারের এস এ সেন্টারে গরিবের চিকিৎসকখ্যাত এই চিকিৎসক। সকাল সন্ধ্যা মধ্যরাত অবধি। যখনই যাই তখনই চোখে পড়ে রোগীর ভিড়। অসহায় রোগীদের তিনি বিনামূল্যে চিকিসাসেবা দেন।
এই চিকিৎসক রোগীদের সেবা দিতে গিয়ে গত বছরের ১ জুন করোনায় আক্রান্ত হন। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ভর্তি হন হাসপাতালে। ওই সময় তার ক্যান্সার আক্রান্ত মায়ের শরীরের অবস্থাও খারাপ ছিল। ৬ জুন হাসপাতাল থেকে পিপিই পরে মাকে একবারের জন্য দেখতে বাসায় আসেন তিনি। সেখানে চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন প্রিয় জননী।
এর এক বছর আগে বাবাকে হারান। মাকে শেষ বিদায় জানিয়ে আবারও ফিরে আসেন হাসপাতালে। পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন মানবতার ফেরিওয়ালা চিকিৎসক পারভেজ। পুরো চট্টগ্রামে যখন অক্সিজেনের সংকট, যখন মানুষ হাহাকার করছে। ওই সময় ব্যক্তিগতভাবে ১০টি অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে শ্বাসকষ্টে ভোগা গরিব রোগীদের সেবা দিয়েছিলেন। এভাবেই করোনা দুর্যোগের সময় সেবা প্রদানের মাধ্যমে অনন্য নজির স্থাপন করেন ডা. পারভেজ।
চিকনদন্ডী এলাকার বাসিন্দা সৈয়দ হাসান মাসুদ মেম্বার জানান, উহানের আকাশের অদৃশ্য এক অণুজীব পুরো পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে ভাবিয়েছিল, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল মুখ থুবড়ে পড়া মানবিকতা। পুরো পৃথিবীর মানুষের পাশাপাশি, আমি আমরা ক্ষত-বিক্ষত মানবতা আমরা দেখেছি প্রতিটি সেক্টরে, প্রতিটি কর্তব্যকর্মে আত্মগোপন করা মানুষ। তিনি জানান, সবাই যেন নিজেকে বাঁচাতে চায়। স্বামী তার প্রিয়তমাকে, সন্তান তার মাকে ছেড়ে পালিয়েছিল। এসব কিছুর ভিড়ে আমরা আমান বাজারে একজন চিকিৎসককে দেখিছি তার নাম ডা. পারভেজ। করোনা অতিমারিতে ফ্রি তিনি রোগীদের সেবাযত্ন করেছেন।
Advertisement
আমানবাজার এলাকার কৃতী-সন্তান কোরিয়াপ্রবাসী মোহাম্মদ হাসান বলেন, আমার পরিবারের লোকজন সবসময় তার কাছে চিকিৎসা করান। তার চিকিৎসা পদ্ধতি, সুন্দর ব্যবহারে আমার পরিবারের সবাই সন্তুষ্ট।
আমানবাজারের কদলখানবাড়ির পরিচিত মুখ ছাত্রনেতা সাহেদ মিজান বলেন, ডা. পারভেজ সম্পর্কে আমার খালাত ভাই। তিনি ব্যক্তিগতভাবে পরোপকারী। তিনি চিকিৎসক হিসেবে করোনাকালে যে মানবিক নজির স্থাপন করেছেন, তা এলাকার মানুষের হৃদয়ের মণি কোঠায় ভাস্বর। তাছাড়া তিনি স্বজন, অসহায়, নিঃস্বদের কাছ থেকে কখনো চিকিৎসা ফি নেন না। নিজেকে এই পথে বিলিয়ে দিয়েছেন।
কথা প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে চিকিৎসক পারভেজ বলেন, এলাকার সবার ভালোবাসায় মা-বাবার অসীম দোয়ায় আজ আমি চিকিৎসক। মানুষের বিপদ-আপদে দুর্দিনে পাশে থাকা আমার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
ডা. পারভেজের ছোট ভাই ডা. সাইফুল ইসলাম ফিরোজ খান বলেন, আমার বড় ভাই সবসময় মানুষের কথা চিন্তা করেন। তিনি সার্বক্ষণিক গরিব নিঃস্ব মানুষের কথা চিন্তা করেন। পাশাপাশি আমাদের সুশিক্ষার পেছনেও তার অবদান রয়েছে।
ডা. ফিরোজ আরও যোগ করেন, একজন চিকিৎসক এ বিপদের দিনে ঘরে বসে থাকতে পারেন না। সেটা আমার পিতৃতুল্য ভাই প্রমাণ করেছেন করোনার দুঃসময়ে চিকিৎসকরা মানবিক ত্রাতা।
এমআরএম/জিকেএস