দেশে মাদকসেবীদের বড় একটি অংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন প্রকারের মাদক কারবারে বা সেবনে জড়িত থাকায় বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গ্রেফতার হয়েছেন। সম্প্রতি লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডি নামে নতুন এক প্রকারের মাদকের সঙ্গে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে। এ নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকদিনে দেশে এলএসডি কারবারের সঙ্গে জড়িত আটজনকে গ্রেফতার করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেফতার সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা গত এক বছর ধরে এলএসডি সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এলএসডির মতো ভয়াবহ মাদকে জড়িয়ে পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক-অভিভাবকরা।
Advertisement
এলএসডি মাদক, এ নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ নিয়ে দুই পর্বের প্রতিবেদন করেছে জাগো নিউজ। আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
বিশেষজ্ঞদের মতে, লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডি মাদক সেবনে মানুষের বিভ্রম (হ্যালুসিনেশন) তৈরি হয়। এই মাদক সেবনের পর মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রভাব (হ্যালুসিনোজেনিক অ্যাফেক্ট) তৈরি হয়, যা ব্যক্তির ব্যবহার ও চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বিশেষ করে এটি নেয়ার পর সাধারণভাবে যে ধরনের রঙ প্রকৃতিতে দেখা যায়, তার চেয়েও বেশি রঙ দেখতে পায় মাদকসেবী।
ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুরের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নেমে এলএসডির খোঁজ পায় পুলিশ
Advertisement
শিক্ষাবিদরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নানা রকম দুশ্চিন্তায় অনেক শিক্ষার্থী মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীরা মাদকে জড়িয়ে পড়ছেন—এটা অনেক কারণের মধ্যে একটি। যেমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সময় তারা কোথায় যাবেন, কোথায় গিয়ে সময় কাটাবেন—এ রকম একটা অবস্থার মধ্যে তারা আছেন। আর শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে চ্যানেল হিসেবে এই মাদক ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে কয়েকটি চক্র। যাদের অনেক টাকা-পয়সা আছে এবং যেসব অভিভাবক টাকা-পয়সার হিসাব করেন না, তাদের সন্তানই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের ‘আত্মহত্যা’র কারণ খুঁজতে তদন্তে নামে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্তের মধ্যে রাজধানীর একটি বাসা থেকে এলএসডি মাদক মাদক জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ। হাফিজুরের ‘নিজেকে শেষ করে দেয়া’র সঙ্গে এই মাদকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। মূলত ওই মৃত্যু তদন্তেই এলএসডি মাদক সামনে চলে আসে।
পুলিশ বলছে, এলএসডি সেবনকারীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তাদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। এছাড়া সম্প্রতি গ্রেফতার বিশ্ববিদ্যালয়ে আট শিক্ষার্থীর চক্র দুটি ছাড়াও এলএসডি কারবারে জড়িত আরও কয়েকটি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইন্টারনেটে এলএসডির বিষয়ে জানতে পেরে এক ধরনের আগ্রহ থেকে দেশের তরুণ সমাজ এই ভয়ানক মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। নতুন কিছুর প্রতি তরুণদের ঝোঁকটা সব সময়ই বেশি। কিন্তু শুধু ঝোঁকের বশে মাদক নেয়াটা বোকামি ছাড়া কিছু না। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এবং অনেকে ‘বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে’ এই মাদকে ঝুঁকে পরতে পারেন বলে ধারণা তাদের।
Advertisement
এ বিষয়ে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. একরামুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এক বছর আগে থেকেই এলএসডি মাদকের ব্যবসা চলছে। যে কোনো একটি মাদক ব্যবসায়ী চক্র শিক্ষার্থীদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়ে তাদের দিয়ে এই ব্যবসা চালাচ্ছে। যেহেতু মাদকটি বাইরের দেশ থেকে আসছে, সেহেতু অবশ্যই এই চক্রের গডফাদার রয়েছে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকায় অভিভাবকদের মনে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি-না—এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের মনেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির আগে অভিভাবকরা বহুবার বহু বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন, ভাবেন। অভিভাবকরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যাচাই-বাছাই করেন।’
সম্প্রতি এলএসডিসহ পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করা হয়
এ বিষয়ে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশে থাকতে এলএসডির কথা শুনলেও বাংলাদেশে এর আগে এই মাদকের কথা শুনিনি। শিক্ষার্থীরা ডিপ্রেশনে (হতাশা) ভুগলেও এই মাদক নেয়ার ব্যাপারে ডিপ্রেশনই একমাত্র কারণ বলে মনে হয় না। যেসব শিক্ষার্থী এলএসডির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন, তারা এর আগে অন্য মাদক নেয়ার পরই এতে এসেছে। এর মধ্যে সিগারেট একটি অন্যতম কারণ বলে মনে হয়। কারণ সিগারেট খাওয়ার পর শুরু হয় গাঁজা, এরপর ইয়াবাসহ ধাপে ধাপে বিভিন্ন মাদকে জড়িয়ে পড়েন তারা। যারা সেবন করে তারা আর্থিক ডিপ্রেশন থেকে মাদক সেবন করে না। পারিবারিক ও রিলেশনশিপের ডিপ্রেশনের কারণে মাদক নেয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।’
ঢাবি শিক্ষার্থী হাফিজুরের মৃত্যুর তদন্তের মধ্যে প্রথমে ২৬ মে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- হাফিজুরের বন্ধু নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব ওরফে রূপল (২৫) ও আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তুর্জ এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আদিব আশরাফ (২৩)। তাদের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা মূল্যের ২০০ ব্লট এলএসডি মাদকও জব্দ করে ডিবি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে এলএসডি নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেসবুকে ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করতো গ্রেফতার চক্রটি। এর মধ্যে ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ ছিল। এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় এক হাজার। গ্রুপটির মাধ্যমে এলএসডি ক্যাশ অন ডেলিভারি করা হতো। এই গ্রুপ ছাড়া অন্যান্য সূত্রের মাধ্যমে ডিবি পুলিশ আরও অনেক এলএসডিসেবীকে চিহ্নিত করেছে।
এরপর ৩০ মে রাজধানীর শাহজাহানপুর, রামপুরা, বাড্ডা ও ভাটারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি গ্রুপের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা সবাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তাদের বয়স ২০-২৪ বছরের মধ্যে। এদের গ্রেফতারের পর পুলিশ জানায়, দেশে এলএসডি সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে ১৫টি সক্রিয় গ্রুপ রয়েছে।
এলএসডি কারবারে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে কাজ চলছে
এসব মাদকসেবীর অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই কথা বলতে চায় ডিবি। ক্ষেত্রবিশেষে তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে তাদের গ্রেফতারও করা হতে পারে। সেবনকারীদের মধ্যে পাচারকারী কারা, আর কারা বিক্রির সঙ্গে জড়িত, তদন্তের মাধ্যমে তাদের বের করতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গোয়েন্দা পুলিশ। এছাড়া কুরিয়ার সার্ভিস পরিচালনার সঙ্গে কেউ জড়িত কি-না তা অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে।
এলএসডি কারবারে জড়িত গ্রুপগুলো শনাক্ত করা গেছে কি-না জানতে চাইলে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি, তারা সরাসরি ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িত। অনলাইনের মাধ্যমে এলএসডি মাদক নিয়ে আসতেন। তাদের শনাক্তকরণ ও গ্রেফতারে কাজ চলছে।
গত ২৬ মে এলএসডিসহ তিনজনকে গ্রেফতার করার পর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, এ মাদক অনেক বেশি ব্যয়বহুল। কয়েক বছর ধরে এলএসডি উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাদক কারবারির সঙ্গে যোগাযোগ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে এই মাদক দেশে আনা হচ্ছে। স্টিকার বা তরল পানি শোষণ করে রাখে এমন কাগজ ব্যবহার করে এটি দেশে আনা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ মাদকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এটি ব্যবহার করলে যে কারও মাথা ভার হয়ে যাবে। হ্যালোজেনিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কেউ যদি গান শোনে, তার সামনে গানের মিউজিকগুলো বিভিন্ন রঙের মতো ঘুরতে থাকে। সেবনকারী অত্যন্ত হিংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক আচরণ করে।
টিটি/এমএসএইচ/এইচএ/জিকেএস