দেশ থেকে যারা বিদেশ যান আমরা তাকে প্রবাসী বলি। কেননা তারা আপন জায়গা ফেলে একটু ভালো থাকার জন্য পরবাসে চলে যান। কেন যান? আমাদের দেশে কর্মসংস্থানের অভাব বলে, বিদেশের মতো সুযোগ-সুবিধা বেশি বলে, বেতন কম বলে ইত্যাদি কারণে।
Advertisement
এই কারণগুলোও থাকত না, আমরা যদি আমাদের দেশের ভেতরের, দেশের মানুষদের জন্য যদি সঠিক উপায়ে সুষ্ঠু কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি করতে পারতাম। এ নিয়ে আসলে একার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নয়, কাজ করতে হবে সরকারকেও।
দেশ থেকে প্রবাসে গিয়ে কি খুব ভালো থাকে কেউ? না, দেশ থেকে সবকিছু ছেড়ে যেমন তার মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের রেখে যখন প্রবাসে একা একটা মানুষ যায় বা কাজ করে তখন তার মনটা কিন্তু পড়ে থাকে দেশের মাটিতেই। মনে পড়ে তার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা, স্ত্রী-সন্তানের কথা। তখন তার আর কাজ করতে ইচ্ছে হয় না।
ইচ্ছে হয় সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পুনরায় দেশে চলে আসতে। কিন্তু না, সময় এবং পরিস্থিতি তা করতে দেয় না, কেননা সে যদি বিদেশ থেকে দেশে এসে পড়ে তবে তার আপন মানুষগুলো অর্থকষ্টে ভুগবে, তিনবেলার খাবার একবেলা খেতে হবে, কোনো কোনো বেলা আবার না খেয়েই থাকতে হবে। এটা তার চোখের সামনে ঘটলে সে সহ্য করতে পারবে না।
Advertisement
তাই শত যন্ত্রণার পরও দেশের মানুষটি প্রবাসে থাকে তার কষ্ট হলেও যাতে তার প্রিয় মানুষগুলো একটু ভালো থাকে, একটু স্বস্তিতে থাকে, একটু সুন্দর থাকে, সে যেন পরবর্তীতে দেশে ফিরে সে মানুষগুলোর হাসিমুখ দেখতে পারে। আহা, তার কাছে তখনই পরম শান্তি বলে মনে হয়। মনে হয় এই মুহূর্তটার জন্যই তো দেশের বাইরে থাকা, খানিক কষ্ট করা।
আব্দুল মালেক (২৯) টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার সুজামুরি গ্রামের মো. মুচারবের ছেলে ২০০৭ সালের কলিং ভিসায় অ্যালমুনিয়াম কোম্পানিতে মালয়েশিয় আসেন। দীর্ঘদিন কাজ করেন কোম্পানিতে। ৩ বছর পর আর ভিসা করেনি কোম্পানি বাধ্য হয়ে কোম্পানি থেকে ফেরারি হন। পরে রি-হিয়ারিং এর আওতায় বৈধতা লাভ করেন কিছুদিন হলো। কাজ করেন মুরগী কাটার দোকানে। মাসে বেতন পান ১২ শ রিংগিত তা দিয়ে চলে না।
পার্ট টাইম কাজ করেন পুত্রাযায়া একটি কাপড়ের দোকানে সেখান থেকে আসে আরো ১ হাজার রিংগিত। সর্বমোট মাস শেষে ২২শ রিংগিত পান। সেখান থেকে নিজের খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা দেশে পাঠিয়ে দেন। ইচ্ছে করলেও নিজের আরাম আয়েশ ছেড়ে বীরদর্পে কাজ করে চলেছেন আব্দুল মালেক। কারণ দেশে দুটি জমজ মেয়ে সন্তান চিনহা/চিন্তা, স্ত্রী, মা-বাবা রয়েছেন। তাদেরকে সুখে শান্তিতে রাখতে এই কষ্ট। আবদুল মালেকের মতো হাজারো আবদুল মালেক মালয়েশিয়ায় কাজ করে যাচ্ছেন।
আমরা আসলে জানি না একটা দেশের ছেলে অন্য আরেকটা দেশের মাটিতে কেমন কষ্ট করে আয়-উপার্জন করে। এই বিষয়গুলো আমাদের জানারও তেমন বিষয় নয়, কেন নয়? এই বিষয়গুলো জানা কি আমাদের দরকার নয়। নাকি এই বিষয়গুলো পাথর চাপা দেয়ার মতো কোনো বিষয়। না, দেশে থেকে একটা মানুষ বুকে কতটা কষ্ট নিয়ে দেশের বাইরে যায় তা হয়তো যে মানুষটা যায় সে মানুষটার থেকে ভালো আর কেউ বলতে পারবে না বা জানে না।
Advertisement
কেননা দেশ থেকে একটা মানুষ সুস্থ অবস্থায় বিদেশে গেল ঠিকই সে মানুষটা বিদেশ থেকে অসুস্থ অবস্থায় ফিরে আসে দেশে। তখন তার প্রিয়গুলোর কষ্ট হয় কিন্তু প্রিয় মানুষ ছাড়া বাইরের কোনো মানুষের কষ্টের লেশমাত্র হয় না। কেননা সে মানুষটা তো শুধু তার আপন মানুষগুলোর জন্যই কষ্ট করছে। তা ভুল। সে মানুষটা কষ্ট করছে একটি দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, দেশের সতেরো কোটি জীবনের জন্য, জীবনগুলোর বেঁচে থাকার জন্য।
তাহলে আমরা কেন প্রবাসে থাকা মানুষটাকে কোনো মূল্যায়ন করছি না বা সম্মান দেখাচ্ছি না বা শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটাও হারিয়ে ফেলেছি তা কেন। তা আমাদের সমাজব্যবস্থা, আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষের কাছে প্রবাসীদের ছোট করে রেখেছে তার কারণ রাজনৈতিক ইস্যু।
এই ইস্যু দ্বারা দেশের প্রত্যেকটা মানুষ বিভক্ত হলেও প্রবাসীরা কিন্তু কখনোই বিভক্ত হওয়ার কথা চিন্তা করে না। কারণ তারা বোঝে যে, দেশটা তো আমার, দেশের মানুষগুলো তো আমার, দেশের মানুষগুলোর এই সুখ-দুঃখ এগুলোও তো আমার। তাহলে কেন দেশ থেকে বিভক্ত হতে যাব। এই বিভক্ত হওয়ার জন্য তো আমাদের প্রবাসে আসা নয়, এই বিভক্ত হওয়ার জন্য তো আমাদের এই রাত-দিন পরিশ্রম করে যাওয়া নয়।
এই বিভক্তের পেছনে লুকিয়ে আছে একটা স্বার্থ। যে স্বার্থটা আসলে দেশের মানুষ বুঝলেও প্রবাসীরা তা বোঝে না, তাদের একটাই চিন্তা যে, আমার দেশের মানুষগুলোকে আমারই ভালো রাখতে হবে। আমরা আসলে টের পাই না বা বুঝতে পারি না আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রবাসীদের ভূমিকা কতটুকু।
প্রবাসীরা এখানে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছে বা কি করে যাচ্ছে। তা আমরা দেখতে পাই গুটিকয়েক মানুষের কথা চিন্তা করলে যেমন মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান যে মানুষগুলোর জন্য একজন মানুষ আসলে বিদেশে যায়। আমাদের বুঝতে একটু কষ্ট হয় যে প্রবাসীরা বিদেশ গেলে কেন দেশে আসে না বা দেশে আসার কথা চিন্তা করে না, না করার কারণ তারা দেশে ফিরলে তাদের আপন মানুষগুলোর যে সুখটা আছে বিদেশ থাকাবস্থায়।
তাদের সে সুখ থাকবে না দেশে ফিরলে। তাদের জন্যই ওদের বিদেশ থাকা, দেশে না ফেরা। দেশের সঙ্গে, দেশের মানুষজনদের সঙ্গে প্রবাসীদের সম্পর্কের কথা চিন্তা করলে আমরা দেখতে পাই দেশের প্রতি, দেশের মানুষজনদের প্রতি প্রবাসীদের যে টান-সে টান দেশের মানুষদের নেই।
কেননা তারা তাদের কাছে থাকা মাতৃভূমিকে অনুভব করতে পারছে না যেমনটা পারে দেশের বাইরে থাকা প্রবাসীরা। দেশের মাটির গন্ধ পর্যন্তও তারা শুকতে পায় কেননা তাদের কাজের মধ্যে থাকে দেশকে উদ্দেশ্য করে খেটে খাওয়া মানুষদের কথা, আপন মানুষগুলোর হাসিমুখের জন্য অপেক্ষা এবং তার আরো কাছের যেমন স্ত্রী-সন্তান তাদের ভালো থাকার কথা।
সন্তানের পড়াশোনার খরচ, বৃদ্ধ মা-বাবার ওষুধের খরচ সবকিছুর কথাই যেন তার মাথায় কেউ গেঁথে রেখেছে যে, তোমার টাকার জন্য তোমার সন্তান স্কুলের বেতন দিতে পারছে না, তোমার বৃদ্ধ মা-বাবা ওষুধ কিনতে পারছে না এই কথাগুলো যেন তার কানে বাজতেই থাকে।
যার জন্য সে তার কাজ ছাড়াও বাড়তি কাজ করে যেন তারা হতাশ না হয় বা যত টাকা খরচ করে ঋণ নিয়ে সে বিদেশ এসেছে তা পরিশোধ করার আগ পর্যন্ত তার যেন কোনো নিদ্রা নেই। সে কাজ করতেই থাকে তার মতো করে। সেই কাজ করার মধ্য দিয়েই মনে পড়ে দেশের কথা, দেশের মানুষজনদের কথা, আরো মনে পড়ে চেনা পরিচিত কিংবা অচেনা অপরিচিত দেশের পথ-ঘাটের কথা।
এমআরএম/জিকেএস