করোনাকালে চরম বিপাকে পড়েছেন সিরাজগঞ্জের গো-খামারিরা। বেড়েছে গো-খাদ্যের দাম। তারপরও খামারে উৎপাদিত দুধের কাঙ্খিত দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। এই অবস্থা দীর্ঘদিন স্থায়ী হলে পথে বসার শঙ্কায় আছেন সিরাজগঞ্জের খামারিরা।
Advertisement
গো-খাদ্যের দাম না কমলে তাদের অনেকের পক্ষে গাভি পালনই সম্ভব হবে না বলে জানান অনেক খামারি। তাই সরকারি প্রণোদনা না পেলে পথে বসার আশঙ্কা জানিয়েছেন তারা।
সিরাজগঞ্জ জেলার প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে সিরাজগঞ্জে সমবায়ভিত্তিক রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার একটি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ কারাখানা গড়ে ওঠে। দুধের দেশ নিউজিল্যান্ড খ্যাত বৃহত্তর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা। ছোট-বড় মিলিয়ে শাহজাদপুরে এখন ৫ শতাধিক বাথান রয়েছে। যেখানে ১ থেকে দেড় লাখ উন্নত জাতের গাভী রয়েছে। আর বাথানকেন্দ্রিক পরিবারের সংখ্যাও ৮০/৯০ হাজার।
এ উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের বসতবাড়ির আঙিনায় ও বাথান এলাকায় গবাদিপশু পালন করা হয়। লক্ষাধিক উন্নতজাতের গাভি পালনের আয়ে এলাকাবাসীর আর্থিক অবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
Advertisement
উন্নতজাতের গাভি পালন করে এসব এলাকার হাজার হাজার কৃষক অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেছে। এমন অনেক খামারি আছেন যাদের কৃষি কাজ করে এক সময়ে দু’বেলা পেটের ভাতই জুটত না, সেই তারাই এখন গাভি পালন করে প্রতিদিন ১ মণ থেকে ২ মণ দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন ২ হাজার টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা আয় করছেন।
আয়ের অর্থ দিয়ে তারা প্রতি বছর জমি-জমা কেনা থেকে শুরু করে ছেলে-মেয়েদের স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে জেলায় ১৫ হাজার ৩৮০টি সমবায়ভিত্তিক গো-খামারের প্রায় সাড়ে ১০ লাখ গবাদিপশু রয়েছে।
রেশমবাড়ি এলাকার খামার মালিক ইব্রাহিম হোসেন, হাবিবুর রহমান ও মোহারক হোসেন বলেন, শাহজাদপুরে দুধকে কেন্দ্র করে নানান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কেউ দুধ পরিবহন করে। কেউ গোবর কিনে সার তৈরি করে। আবার কেউ ঘাস চাষ করে বিক্রি করেন।
একটা সময় এ অঞ্চলে কর্মসংস্থানের বড় উৎস ছিল তাঁত। এখন গরু পালন আয়ের পথ দেখাচ্ছে। তবে করোনার কারণে সেই ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। গাভি লালন-পালন করা অনেক কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার খাবার প্রস্তুত করে খাওয়ানো, পরিচর্যা, দুধ দোহন করা, গোয়াল পরিষ্কার করা, গাভির গোসল সবই সময় ও শ্রমের ব্যাপার। গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা খুবই বিপদে আছি।
Advertisement
খামারিরা আরও বলেন, করোনার জন্য আমরা খুবই অসহায় হয়ে পড়েছি। ঠিকমতো দুধ বিক্রি করতে পারছি না। তবে গো-খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় চরম বিপদে পড়ে আছি।
গমের ছাল বস্তাপ্রতি ১১শ’ টাকার জায়গায় হয়েছে ১২শ’ টাকা, কাউফিড বস্তাপ্রতি ৯শ’ টাকার জায়গায় বেড়ে হয়েছে ১০৫০ টাকা। ডালের ভুসি বস্তা (৩৫ কেজি) প্রতি কিনতে হচ্ছে ১২শ’ টাকা, এ্যাংকর ডালের ভুসি ৮শ’ টাকা টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। ধানের খড়ের দামও বেশি। ৬শ’ টাকা মণ দরে খড় কিনতে হচ্ছে। প্রতি শতাংশ জমির জাম্বু ঘাস কিনতে হচ্ছে ৩০০ টাকা দরে, প্রতি শতাংশ জমির নেপিয়ার ঘাস ৪০০শ’ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে। এক কেজি খৈলের দাম ৪০-৪২ টাকা।
তাহলে কৃষক কীভাবে দুধেল গাভিকে খৈল খাওয়াবেন? দুধ বিক্রি করে গরু খাদ্যই কিনতে পারছি না। এ অবস্থায় গো-খাদ্যের দাম কমানো না হলে কিংবা খামারিদের ভর্তুকি মূল্যে গো-খাদ্য না দিলে তাদের পক্ষে খামার রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠবে। আমাদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে সরকারের প্রণোদনার উদ্যোগ নিতে হবে।
বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়নের (মিল্কভিটা) সাবেক সভাপতি হাসিব খান তরুণ জানান, বৃহত্তর পাবনা জেলায় অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীরা পাবনার ভাঙ্গুড়া ক্রয়কেন্দ্র, সিরাজগঞ্জের লাহিড়ী মোহনপুর ও বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করেন।
এ অঞ্চলে প্রায় এক হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতির মাধ্যমে এ দুধ সরবরাহ হয়। সমিতিভুক্ত মোট সদস্যের সংখ্যা ৫০ হাজার। এছাড়া সমিতির বাইরেও কয়েক হাজার খামারি দুধ সরবরাহ করে থাকেন। এছাড়া ৭৫ থেকে ৮০ হাজার লিটার দুধ আফতাব, আকিজ, প্রাণ, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ২৮ থেকে ২৯ হাজার লিটার দুধ কিনে থাকে।
বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুধ কিনে প্রক্রিয়াজাত করে রাজধানীতে পাঠাতে অনেক বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছে। অধিকাংশ স্থানে খামারিরা বাড়ি বসেই দুধ বিক্রি করতে পারেন। ঘোষরা বাড়ি-বাড়ি গিয়ে দুধ কিনে এসব কেন্দ্র সরবরাহ করেন।
তিনি জানান, এখন কাঁচা ঘাস ও খেসারি না থাকায় অনেক খামারিরা বাথান থেকে গরু খামারে নিয়ে এসেছেন। এ সময়ে গো-খাদ্য বেশি কেনা লাগছে খামরিদের। এজন্য দুধের উৎপাদন খচর বেশি পড়ছে। তবে চাষিরা দুধের দাম ভালো পাচ্ছেন। গো-খাদ্যের দাম কম থাকলে খামরি ও চাষিরা আরো লাভবান হতে পারতেন।
তিনি বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার লাহিড়ী মোহনপুর এলাকায় সরকারি ২৭ কোটি টাকা সরকারি অর্থ সহায়তা ও মিল্কভিটার অর্থায়নে একটি গো-খাদ্য প্লান্ট করা হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের সমবায়ী গো-খামারিরা ন্যায্য মূল্যে সুষম গো-খাদ্য ক্রয় করে সার্বিকভাবে লাভবান হচ্ছিলেন। সেখান থেকে খামারিরা গো-খাদ্য কিনে একমাস পরও টাকা দিতে পারতেন। তাদের দেয়া দুধের টাকা থেকেও মিল্কভিটা গো-খাদ্যের টাকা সমন্বয় করে দেয়া হতো।
তিনি জানান, দুঃখজনক ব্যাপার হলো গত তিন মাস ধরে সেখানে কোনো গো-খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে না। নানা অজুহাতে বন্ধ রাখা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে খামারিদের গো-খাদ্য কেনায় সহজেই ভর্তুকি দেয়া সম্ভব। কারণ এখানে যারা দুধ দেবেন তারাই ভর্তুকিতে গো-খাদ্য কিনতে পারবেন। এতে কোনো ভুয়া খামারির কম দামে গো-খাদ্য কেনার সুযোগ থাকবে না। খামারিদের লাভবান করতে এ প্রতিষ্ঠানটিকে সরকার ব্যাপকভাবে কাজে লাাগতে পারে। খামারিরা সাশ্রয়ী দামে গো-খাদ্য কিনতে পারলে ভোক্তা এবং উৎপাদনকারী উভয়ই স্বস্তি পেতেন।
প্রাণ ডেইরি মিল্কের শাহজাদপুরের এজিএম ইফতেখারুল ইসলাম জানান, এবার রমজানের আগে দু’দফায় দুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে চাষিরা ফ্যাট ভেদে ৪৩-৫০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে পারছেন। তিনি জানান, ক্ষেত্রবিশেষ ফ্যাটের মাত্রা বেশি হলে চাষিরা ৫৫ টাকা লিটার পর্যন্ত দাম পাচ্ছেন। শাহজাদপুর উপজেলাসহ বৃহত্তর পাবনায় শুধু প্রাণেরই প্রায় ৩০টি দুগ্ধ ক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সব কোম্পানিই দুধের দাম বেশি দিচ্ছেন খামারিদের।
শাহজাদপুর রেশমবাড়ির খামারি ও মিল্কভিটার পরিচালক আব্দুস সামাদ ফকির জানান, শাহজাদপুর অঞ্চলের উৎপাদিত দুধের প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার প্রাণ, আড়ং, অ্যাংকার ও ঈগলু কেনে। অবশিষ্ট ৯ লাখ লিটার দুধ ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার হোটেল ও মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করা হত।
করোনা ও লকডাউনে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নামমাত্র মূল্যে দুধ বিক্রি করা হয়েছে। এরপরও গো-খাদ্যের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় গরুর দুধ বিক্রি করেও গো-খাদ্যই কিনতে পারছে না খামারিরা। এভাবে চলতে থাকলে খামারিরা পথে বসবেন। খামারিদের এগিয়ে নিতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার দাবি জানান এই পরিচালক।
গো-খাদ্য সংকটের কথা স্বীকার করে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, করোনাকালীন খামারিদের কথা ভেবে মিল্কভিটা, প্রাণ, আড়ং, অ্যাংকার, ঈগলু কোম্পানিগুলো যথাযথভাবেই দুধ ক্রয় করছেন। খামারিদের উৎপাদিত অবশিষ্ট দুধ বাজারে ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এগুলো প্রাণিসম্পদ অফিসের কর্মকর্তারা মনিটরিং করেছেন।
তিনি বলেন, করোনায় খামারিরা লোকসানের বিষয়টি মাথায় রেখে খামারিদের তালিকা তৈরি করে সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। আশা করি সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনাসহ সবধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন খামারিরা।
এমআরএম/জিকেএস