পরনে একটি লাল রঙা জামা। চুলগুলো একপাশে সিঁথি করে বেঁধে রাখা। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে একটি লাল রঙা হিজাব মাথায়। ঠোঁটে হালকা করে লাল রঙা লিপস্টিক দেওয়া। গালে বাম হাত দিয়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছেন সবার দিকে।
Advertisement
এতেই অসামান্য দেখাচ্ছে তাকে। বলছি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাইয়ের কথা। সব নারীর জন্য আইডল তিনি। আরেকটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, লাল পোশাকের সঙ্গে নীল রঙা ওড়না মাথায় দিয়ে বসে আছেন মালালা। আরেকটি ছবিতে সাদা শুভ্র পোশাকে অনন্যা লাগছে মালালাকে।
সম্প্রতি মালালা ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ভোগের প্রচ্ছদ মডেল হয়েছেন। লাল প্রচ্ছদে মালালা যেন এক অপরূপ মোহ তৈরি করেছেন। ভোগ প্রচ্ছদে নিজেকে দেখে উচ্ছ্বসিত মালালা এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, যে মেয়েরাই এ প্রচ্ছদে আমাকে দেখবে, সে জানবে এবং সেও চাইলে এই বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে।’
২৩ বছর বয়সী এই নারী ভোগ ম্যাগাজিনের জুলাই সংখ্যার প্রচ্ছদ মডেল হয়ে নিজের জীবন, ভবিষ্যত, বিয়ে, পরিবার, কাজের পরিকল্পনা সব বিষয়ে বিস্তারিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। গত বছর মালালা সবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।
Advertisement
মালালা ইউসুফজাই ১৯৯৭ সালের ১২ই জুলাই উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের সোয়াত জেলায় এক সুন্নি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই মালালার প্রতিবাদী রূপ দেখে বিশ্ব। তখন থেকেই নারী শিক্ষা নিয়ে প্রচার চালানো শুরু করেন মালালা।
এজন্য তালেবান জঙ্গিদের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়েছিলেন মালালা। জঙ্গিদের ছোঁড়া তিনটি গুলির মধ্যে একটি তার কপাল ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। বেশ কয়েকদিন অজ্ঞান থাকার পর বেঁচে ফেরেন প্রতিবাদী এই আন্দোলনকর্মী।
মালালা বলেন, ‘এতো বড় একটি ঘটনা থেকে আমি সেরে উঠেছিলাম এবং নিজের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া স্বপ্ন দেখেছিলাম। এরপর থেকে আমি বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেছি। একটি বই প্রকাশ করছি এবং একটি ডকুমেন্টরিও করছি। সম্প্রতি আমি স্নাতক সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে অবসার সময় কাটাচ্ছি। নিজেকে পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত করছি।’
হিজাব পরা নিয়ে মালালা তার সাক্ষাৎকারে জানান, ‘হিজাব পরা মানেই, এই নয় যে আমি নিপীড়িত’। ব্রিটিশ ভোগের জন্য মাথায় লাল হিজাব পরে মালালা বলেন, পোশাকটিতে ‘নিপীড়িত’ হওয়ার চিহ্ন নেই বরং এটি আমার পরিচয় বহন।’
Advertisement
‘একজন মুসলিম নারী হিসেবে আমার হিজাব পরিধান করা উচিত। আর সেটাই আমি অনুসরণ করি। এ ছাড়াও পাকিস্তানিদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মধ্যে হিজাবও আছে। আমি সবাইকে বলতে চাই, সবার উচিত নিজের সংস্কৃতি ধরে রাখা। আপনার সংস্কৃতিই আপনার পরিচয় বহন করে।’
মালালা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাক্টিভিজম সম্পর্কে সমালোচনা করে বলেন, ‘অনেকেই বলেন ‘পরিবর্তন দরকার’। অবশ্যই পরিবর্তন দরকার, তবে টুইটারে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই শুধু সেই পরিবর্তন সীমাবদ্ধ আছে। টুইটার সম্পূর্ণ অন্য এক বিশ্ব।’
বর্তমানে মালারার সখ্য গড়ে উঠেছে ১৮ বছর বয়সী জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থানবার্গের সঙ্গে। গ্রেটাও একজন কনিষ্ঠ আন্দোলনকর্মী। এ বিষয়ে মালালা বলেন, ‘আমি জানি একটি ছোট মেয়ের মধ্যেও কতটুকু শক্তি থাকতে পারে, যা তাকে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে।’
২০১৪ সালে মালালা ইউসুফজাই নোবেল শান্তি পুরষ্কারের সর্বকনিষ্ঠতম বিজয়ী হন। এরপর থেকেই একজন পাকিস্তানী আন্দোলনকর্মী হিসেবে নারী শিক্ষার সর্বজনীন অধিকার পাওয়ার জন্য প্রচার চালিয়ে আসছেন মালালা।
মালালা ইউসুফজাই স্বীকার করেন, তিনি অক্সফোর্ডে শিক্ষা গ্রহণকালে ব্যক্তিগত কোনো বিবৃতিতে নিজের নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার বিষয়ে কিছুই লেখেননি। তিনি বলেন, ‘আমি কিছুটা বিব্রতবোধ করি।’
দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছেন মালালা। তিনি বলেন, সারারাত ধরে আমি প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন বিষয়ের উপর রচনা লিখতাম। আবার নিজের উপর রাগ হতো, কেন আমি রাত ২ টায় বসে এই প্রবন্ধটি লিখছি, নিজের পড়ালেখা বাদ দিয়ে? কারণ আমি আরও শিখতে চাই, জানতে চাই, বলেন মালালা।
নোবেল জয়ের পর বার্মিংহামে শিক্ষা জীবন শুরু করেন মালালা। প্রাণের ঝুঁকি থাকায় পাকিস্তান ত্যাগ করে বার্মিংহামেই পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। তখন তাকে সবাই চিনতো, স্কুলের সহপাঠি থেকে শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষিকা সবাই মালালার মুখ থেকে বিভিন্ন গল্প শোনার জন্য অপেক্ষায় থাকতেন।
‘সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করত, আপনি যখন এমা ওয়াটসন, বা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বা বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন; তখন কেমন মনে হয়েছিল, ইত্যাদি?’ ‘আমি এসব প্রশ্নের উত্তর কী দিবো, তাও জানতাম না। হয়তো আমার খ্যাতির কারণেই তারা আমাকে বন্ধু ভেবে এসব উদ্ভট প্রশ্ন করত!’
বর্তমানে মালা ইউসুফজাই তার পিতামাতার সঙ্গে বার্মিংহামে বসবাস করছেন। করোনা পরিস্থিতিতে পরিবারের সঙ্গেই সময় কাটাচ্ছেন তিনি। ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখন আমি কী করবো সে সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। আমি নিজেকেই জিজ্ঞাসা করি, ‘আমি কোথায় থাকবো যুক্তরাজ্যে না-কি পাকিস্তান? না-কি আমার অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়া উচিত?’
মালালা জানান, ‘আমার বাবার কাছে প্রায়ই পাকিস্তানের বিভিন্ন লোকেরা আমাকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দেন। তারা জানায় অনেক জমি এবং বাড়ি আছে। তারা আমাকে বিয়ে করতে চায়! তবে মালালার মত কী?
বিয়ে বিষয়ে মালালা ইউসুফজাই বলেন, ‘আমি এখনও নিশ্চিত নই যে, আদৌ বিয়ে করব কি-না? আমার মনে হয়, সত্যিই কি বিয়ে করা জরুরি? আমার মা অবশ্য বলেন, ‘আমাকে অবশ্যই বিয়ে করতে হবে এবং খুব ভালো মানুষের সঙ্গেই না-কি আমার বিয়ে হবে!’
মালালা আরও বলেন, ‘আপনি যদি কাউকে সত্যিই নিজের জীবনে চান তাহলে বিয়ের কাগজপত্রে কেন স্বাক্ষর করতে হবে? একে অপরের সহযোগী হয়ে থাকা যায় না? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েও আমি ভাবতাম, ‘কখনোই বিয়ে করব না এবং আমার কোনো সন্তানও থাকবে না।’
‘কারণ আমি শুধু মনোযোগ দিয়ে আমার কাজগুলোই করে যেতে চাই। সব মিলিয়ে আমি সুখী। আমার কোনো উচ্চভিলাষী প্রত্যাশা নেই। শুধু লক্ষ্য পূরণের ইচ্ছা সবসময় আমাকে তাড়া করে। পরিবারের সবাইকে নিয়ে থাকার আনন্দে সবসময় আমি আপ্লুত থাকি। তবে সবারই উচিত নিজের জন্য ভবিষ্যতের অনুসন্ধান করা।’
সূত্র: ভোগ/বিবিসি
জেএমএস/জেআইএম