আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের ৪ সহযোগীর তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে মুদ্রা পাচার ও মানবপাচার চক্র। দেশীয় একটি সংঘবদ্ধ চক্রের যোগসাজশে বাংলাদেশেও মানবপাচার ও মুদ্রা পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ ব্যবসা চলছে।শুক্রবার দুপুর সোয়া ১২টায় র্যাব সদর দফতরে আয়োজিত এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং এর পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।এর আগে এক অভিযানে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ভারতীয় জাল রুপি প্রস্তুতকারক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা এবং মানবপাচারকারী চক্রের ১ জন পাকিস্তানি নাগরিকসহ ৬ জনকে আটক করে র্যাব।এসময় তাদের কাছ থেকে ১ কোটি ভারতীয় জাল রুপি, নগদ অর্থ, বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, দেশি-বিদেশি পাসপোর্ট এবং মানবপাচারে ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।মুফতি মাহমুদ খান বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-১ এর একটি দল বৃহস্পতিবার রাতে বিমানবন্দর ফুট ওভার ব্রিজ এলাকা থেকে ভারতীয় জালমুদ্রা পাচারকারী চক্রের অন্যতম মূলহোতা আব্দুল্লাহ ওরফে সেলিম (৪২), মো. জাহাঙ্গীর (৪৫), মো. আব্দুল খালেক(৫৫) কে আটক করে। এসময় ৭০ লাখ ভারতীয় জাল রুপি, ৯ হাজার ১ শ’ ২৫ ইউএস ডলার, ২১টি পাকিস্তানি পাসপোর্ট, ৭ বাংলাদেশি পাসপোর্ট, ১০০ সৌদি রিয়াল, মানবপাচারে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সিল ও সিল তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে দেয়া তথ্যমতে, চক্রটির অপর ৩ সদস্যকে শুক্রবার ভোর রাতে বিমানবন্দর থানাধীন বাবুস সালাম মসজিদ-মাদ্রাসা সংলগ্ন আল আমিন রেস্তোরার সামনে থেকে আটক করা হয়। তারা হলেন, মো. কামরুল ইসলাম (২৮), মো. আবু সুফিয়ান (৪৮), মামুনুর রশিদ (৪৫)।এসময় তাদের কাছ থেকে ৩০ লাখ ভারতীয় জাল মুদ্রা, ৬ লাখ ২৩ হাজার ৫ শ’ বাংলাদেশি টাকা, ৪৩ হাজার ১৯০ পাকিস্তানি রুপি, ১৩ হাজার ৬শ’ ২৭ ইউএ ই দিরহাম, ৭টি এয়ারপোর্ট ভিজিটরস কার্ড, ৫টি মোবাইল ফোন, ৪টি বিদেশি সিমকার্ড, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এবং ট্রাভেল পারমিট ফরম।প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানায়, আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের ৪ সহযোগী আসলাম সুরিয়া, আরিফ, জাভেদ ও হানিফ পাকিস্তানে অবস্থান করে মানব ও মুদ্রা পাচার করে আসছে। তারা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বিভিন্নভাবে ভারতীয় জালমুদ্রা ভারতে পাচার করছে।আটক জাহাঙ্গীর, বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত পাকিস্তানি নাগরিক আব্দুল্লাহ সেলিম এবং আব্দুল খালেক বাংলাদেশি চক্রের প্রধান সমন্বয়ক।র্যাবের এ গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আরো বলেন, পাকিস্তানে অবস্থানরত পাসপোর্টবিহীন যে সমস্ত বাংলাদেশি নাগরিক দেশে ফিরতে ইচ্ছুক তাদেরকে পাকিস্তানে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন কর্তৃক আউট পাস ইস্যু করে বিশেষভাবে লাগেজ এবং ক্রোকারিজ আইটেমের মাধ্যমে ভারতীয় জালমুদ্রাসহ বাংলাদেশে পাঠায়।বাংলাদেশের বিমানবন্দরের কয়েকজন কর্মচারী এই চক্রের সঙ্গে জড়িত দাবি করে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, বাংলাদেশে অবতরণের পর বিমানবন্দরে একটি চক্র যাত্রীদেরকে ভারতীয় জালমুদ্রাসহ ইমিগ্রেশন এবং গ্রিন চ্যানেল অতিক্রম করানোর দায়িত্ব নেয়। এদের অন্যতম হোতা কামরুল। যিনি বিমানবন্দরে অবস্থিত একটি বেসরকারি ফাস্টফুড এর দোকানের নামে পাসপোর্টের অবৈধ ব্যবসা করে আসছিল।আব্দুল্লাহ ও আব্দুল খালেক বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহার করে পাকিস্তান থেকে আগত যাত্রীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে ভারতীয় জাল মুদ্রা ঢাকার কাজীপাড়া, মিরপুর, গাবতলী এবং গুলিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে আরেকটি চক্রের কাছে হস্তান্তর করে। তাদের অন্যতম এ দেশীয় সদস্য মামুনুর রশিদ।রশিদ এই জালমুদ্রার আরেক চক্রের মাধ্যমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্য দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় পাঠানোর কাজ করে।তিনি আরো বলেন, বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রার বাজার তৈরি হছে বাংলাদেশে। এসব জাল মুদ্রা ক্রয় করে বাংলাদেশি নাগরিকরা ভারতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন।জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা আরো জানায়, চক্রটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার বাসিন্দা জামাল, নিস্ফল মন্ডল, প্রশান্ত মন্ডল এবং উত্তম কুমার সিনহাসহ আরো অনেকের কাছে ভারতীয় প্রতি লাখ জাল মুদ্রা ৪০ থেকে ৪৫ হাজার ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় বিক্রয় করেছে।ভারতীয় চক্রটি হুন্ডি এবং গরুর মাধ্যমে উক্ত জাল মুদ্রার পেমেন্ট করে। হুন্ডির ক্ষেত্রে ভারতীয় চক্রটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলায় অবস্থিত হাওয়ালা অপারেটরের পরিচালক রাজন কর্মকারকে পেমেন্ট করত।রাজন কর্মকার বাংলাদেশি এজেন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানায় অবস্থিত অপর একটি চক্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী চক্রটিকে পেমেন্ট করত।মুফতি মাহমুদ খান বলেন, এই চক্রটি শুধু মুদ্রা পাচার নয়, মানবপাচারের সঙ্গেও সম্পৃক্ত। এজন্য তারা জাল সিল ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে বিভিন্ন ডকুমেন্ট তৈরি করে মানবপাচার করে আসছে।যে সমস্ত পাকিস্তানি নাগরিক বাংলাদেশে এসে অবৈধ হয়ে পড়েছে তাদেরকে জাল অনুমতিপত্র তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থান করার সুযোগ করে দিচ্ছে।চক্রটি ইতোপূর্বে এরূপ জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে বহু অবৈধ প্রবাসীদেরকে দেশে প্রেরণ করেছে।র্যাব এর আগেও বেশ কয়েকটি অভিযানে মোট ৬ কোটি টাকা সমমূল্যের জাল রুপি জব্দ করেছে। জাল মুদ্রা ও মানবপাচারে সক্রিয় চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আটককৃতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান তিনি।জেইউ/এসএইচএস/পিআর
Advertisement