সুজলা-সুফলা বাংলা বলতে যা, চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলা তেমন একটি এলাকা। পূর্বদিকে পাহাড়-টিলা, পশ্চিমদিকে নদী-সমুদ্র, মাঝখানে সমতল ভূমি। খবরে দেখছি হঠাৎ সেখানে পানির হাহাকার! পুকুরের পানি শুকিয়ে মাছ মারা যাচ্ছে, গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বারৈয়ার হাট এলাকায় বন উজাড় করে শিল্প গড়ে উঠছে। বিশেষ করে একটি ইস্পাত প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে ফুঁসিয়ে উঠছে এলাকার জনগণ। অথচ কয়েক বছর আগে এই বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী যখন চট্টগ্রাম শহর যাওয়ার পথে বারৈয়ার হাট পেরিয়ে অদূরে সোনাপাহাড়ে স্টীল মিল ফ্যাক্টরি করে তখন এলাকার মানুষ আশাবাদী হয়েছিলেন যে, স্থানীয় লোকজনের কর্মসংস্থান হবে।
Advertisement
বেশ কয়েকদিন ধরে জাতীয় পত্রিকাগুলো, জাগো নিউজসহ অনলাইনগুলোতে মীরসরাইর বিএসআরএম সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। পরিস্থিতি যখন এমন সেদিন ফেইসবুকে অনেকে পোস্ট দিচ্ছেন। আমার ফেইসবুকে আছেন এনামুল গোফরান চৌধুরী। তিনি দেশের বৃহত্তর একটি শিল্প গ্রুপের হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম শহরে বসবাস শেষে বাকী জীবন মীরসরাইতে কাঠানোর জন্য চিনকি আস্তানা এলাকায় বিলাশবহুল বাড়ি করেছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে কীভাবে থাকবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। সেটা নিয়ে পোস্ট দেন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের বিষয়ে কথা বলেন।
এরমধ্যে নিউজ হয়েছে বিএসআরএম-এর বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ মানববন্ধন করছে। স্থানীয় এমপি এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ৩০ মে ২০২১ সকাল ১০টায় মীরসরাই উপজেলার সোনাপাহাড়ে অবস্থিত কারখানাটির মূল ফটকের সামনে সহস্রাধিক এলাকাবাসীর উপস্থিতিতে মানববন্ধনের প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখেন। তিনি বিএসআরএম গ্রুপের কারখানাটি আগামী এক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে সরিয়ে নেওয়ার আল্টিমেটাম দেন। কারখানাটির কর্তৃপক্ষকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন আগামী দুই মাস কারখানায় কাঁচামাল ঢুকতে দেয়া হবে না। এ সময়ের মধ্যে তাদেরকে ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে বলেন তিনি।
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ বলেন, ‘মীরসরাই কৃষিপ্রধান এলাকা। বিএসআরএম এখানে এসে ধীরে ধীরে পাহাড় দখল করে বিশাল কারখানা গড়ে তুলেছে। শিল্প কারখানা আমাদের প্রয়োজন আছে। সেজন্য মীরসরাইয়ে ইকোনমিক জোন করা হয়েছে। এ এলাকায় কোনও শিল্প কারখানা থাকলে তা ইকোনমিক জোনে স্থানান্তরিত হোক। বিএসআরএম কারখানা প্রতিষ্ঠা করার আগে বলেছিল, ফেনী নদী থেকে পানি এনে তা পরিশোধন করে ব্যবহার করবে। কিন্তু তা না করে ১০-১২টি গভীর নলকূপ বসিয়ে তারা কাজ চালাচ্ছে। গভীর নলকূপ বসানোর কারণে এলাকার মানুষ পানি পাচ্ছে না। সব শুকিয়ে গেছে।’
Advertisement
পরিবেশের ক্ষতি করা বা বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনে কারখানাটি সরানো সম্ভব কিনা- এই নিয়ে বিএসআরএম-এর কোনো বক্তব্য চোখে পড়েনি। তবে এই বিষয়টি আমি জানতে চেয়েছিলাম বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটির নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরীর কাছে। তিনি জানালেন, ‘বিএসআরএম স্টীল এবং জ্বালানি উৎপাদনের জন্য দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনে ১৫৬ একর জমি নিয়েছে। জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। তারা জমি উন্নয়ন করলে অসম্ভব না।’ প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, স্টীল মিল স্থাপনের জন্য বিএসআরএম সবচেয়ে বেশি ১৪০ একর জমি পেয়েছে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনে। জাপানের নিপ্পন অ্যান্ড ম্যাকডোনাল্ড কোম্পানিও ১০০ একর জমি নিয়ে স্টীল মিল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে।
একদিকে, বিএসআরএম-এর কারণে পরিবেশ বিপর্যয় অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনের বাস্তবায়ন এগিয়ে যাওয়ায় মীরসরাইয়ের দৃশ্যপট আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আকাশ-পাতাল পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমার। বঙ্গবন্ধু ইকোনমিক জোন অথরিটি বা বেজার তথ্য মতে, প্রকল্পটি মূল অংশ মীরসরাইতে হলেও চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড ও মীরসরাই উপজেলা এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পিত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শিল্পনগর হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও অনুশাসন অনুযায়ী চূড়ান্ত মাস্টার প্ল্যানে শিল্পনগরকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।
এ নগরকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদানের জন্য ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের সর্বপ্রথম সুপারডাইক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে ঢাকা- চট্টগ্রাম - কক্সবাজারের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেরিন ড্রাইভ রোডের সাথে সুপারডাইকটিকে সংযুক্ত করার অপার সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। শিল্প প্রতিষ্ঠান ছাড়াও আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা, বিজনেস হাব, সার্ভিস জোন, প্রশাসনিক/প্রাতিষ্ঠানিক এলাকা ও পুর্নবাসন এলাকা, লজিস্টিক হাবসহ প্রতিবেশবান্ধব শিল্পনগর প্রতিষ্ঠা করার জন্য সবুজ পার্ক, মাঠ এবং জলাশয়সহ প্রচুর উন্মুক্ত এলাকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। শিল্পের জন্য পানি সরবরাহ করার লক্ষ্যে ডিস্যালাইনেশন প্ল্যান্ট, বর্জ্য পরিশোধনের জন্য CETP স্থাপন করা হবে।
ইতোমধ্যে ২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ এখানে নিশ্চিত হয়েছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে জাপানের নিপ্পন, ভারতের এশিয়ান পেইন্টস, যুক্তরাজ্যের বার্জার পেইন্টস, সিঙ্গাপুরের উইলমারসহ আরও অনেকে এবং দেশি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সব বড় শিল্প গ্রুপ রয়েছে। এ শিল্পনগরে বর্তমান ১৩টি শিল্প নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে আরও ১৫টি প্রতিষ্ঠান শিল্প নির্মাণের অংশ হিসেবে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। জুলাই মাস নাগাদ কমপক্ষে দুটি শিল্প কারখানা উৎপাদনে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের মাধ্যমে ১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে ধারণা। কোভিড-১৯ মহামারীর সময়েও এই শিল্পনগরের জন্য প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব গৃহিত হয়েছে।
Advertisement
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম