৩০ বছর বয়সী যুবক শরিফুল ইসলাম মারুফ এলাকায় ‘পোড়া’ নামেই বেশি পরিচিত। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের মৃত আসাদ আলীর ছেলে তিনি। জন্মের দেড় বছর পরেই ধান সিদ্ধ করা চুলাতে পড়ে পুড়ে যায় তার দুটি হাত এবং মুখের কিছু অংশ।
Advertisement
এরপর থেকেই অচল দুটি হাত নিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া মারুফ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মারুফ সর্ব কনিষ্ঠ। বাবা মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। তার বৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগমও ব্রেন স্ট্রোক করে দীর্ঘদিন থেকে বিছানায় শয্যাশায়ী।
পুড়ে যাওয়া দুটি হাত নিয়েই দরিদ্র ঘরের সন্তান মারুফ প্রাথমিক পেড়িয়ে মাধ্যমিকের বারান্দায় পা রেখেছিলেন। তবে পরিবারের অভাবের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শিক্ষাজীবন থেমে যায় মারুফের।
এরপর জীবনের নেমে আসে কর্মযুদ্ধ। অচল দুটি হাত নিয়ে মানুষের হোটেলে কাজ শুরু করেন তিনি। তবে অচল হাত নিয়ে বেশি দিন টিকে থাকতে পারেননি হোটেলে। সর্বশেষ দীর্ঘদিন হাটে-বাজারে নাইট গার্ডের কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে বাজারে এবং রাস্তাঘাটে হাত পেতে জীবন চলে প্রতিবন্ধী মারুফের।
Advertisement
ছোটবেলার ইচ্ছা ছিল, তিনি ভালো একজন খেলোয়াড় হবেন। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও ক্রীড়া চর্চায় তার বেশ আগ্রহ ছিল। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আঞ্চলিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ফুটবল খেলতেন তিনি। স্থানীয় ফুটবলের জগতে বেশ সুনামও কুড়িয়েছিল মারুফ। তবে পেটের তাগিতে এবং শারীরিক অক্ষমতায় ফুটবলের জগত থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে।
প্রতিবন্ধীদেরকে পুনর্বাসন এবং সহযোগিতায় সরকার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিলেও, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং জন্মনিবন্ধনের বেড়াজালে আজ পর্যন্ত কোনো সরকারি সুবিধা ও সহযোগিতা পাননি প্রতিবন্ধী মারুফ। বয়স প্রমাণে টিকার কার্ড এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনো কাগজ না থাকায় আজ পর্যন্ত করতে পারেনি জন্মনিবন্ধনের কার্ড।
পাশাপাশি পুড়ে যাওয়া দুটি হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট না থাকায় এবং মুখের অনেকাংশ পুড়ে যাওয়ায় চোখের আইরিশ স্ক্যানে জটিলতা থাকায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি মারুফ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করা ৩০ বছর বয়সী মারুফ কাগজে কলমে আজও বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারেননি।
জন্মনিবন্ধনের কার্ড করতে তিনি ঘোড়াঘাট পৌরসভার বারান্দায় ঘুরেছেন দিনের পর দিন। কিন্তু যথাযথ কাগজ না থাকায় জনপ্রতিনিধিদের হাতে-পায়ে ধরেও জন্মনিবন্ধন কার্ড করতে পারেননি মারুফ। একই ভাবে উপজেলা নির্বাচন কমিশনের কার্যালয়েও ঘুরেছেন পাগলের মতো। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থতার দাগ নিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাকে।
Advertisement
ফলে প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের দেয়া বিভিন্ন সহযোগিতা পাবার জন্য দিনের পর দিন আবেদন করলেও জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় কোনো সুযোগ সুবিধা কপালে জোটেনি প্রতিবন্ধী মারুফের।
প্রতিবন্ধী শরিফুল ইসলাম মারুফ বলেন, ‘আমার বাপ-দাদার কয়েকটি প্রজন্ম বাংলাদেশে জন্ম। তবে আমার ৩১ বছর চলমান হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারলাম না। জন্মনিবন্ধনের জন্য পৌরসভায় শত শত বার ঘুরেছি। টিকার কার্ড এবং বাড়ির ট্যাক্সের কাগজ নিয়ে আসতে বলে।’
তিনি বলেন, ‘টিকার কার্ড নেই। বাবা-মা আদৌ আমাকে টিকা দিয়েছে কিনা, তাও জানি না। আর ট্যাক্সের কাগজ? মাথা গোজার ঠাঁই নেই। ভাঙা একটি ঘরে থাকি। খেয়ে না খেয়ে দিন চলে। তো ট্যাক্স দেবো কোথায় থেকে? আর ট্যাক্সের কাগজই বা পাব কোথায়? ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়েও একই সমস্যা।’
প্রতিবন্ধী মারুফ বলেন, ‘অচল দুটি হাত দিয়ে কিছু করতে পারি না। তবুও কষ্ট করে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজকর্ম করি। উপজেলা সমাজসেবা অফিসে একাধিকবার সহযোগিতার জন্য গিয়েছিলাম। তারাও ভোটার আইডি কার্ড অথবা জন্ম নিবন্ধন নিয়ে আসতে বলে।’
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার চেয়েও সুস্থ অনেক প্রতিবন্ধী প্রতিনিয়ত সরকারের বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে। আমি শুধু চোখ মেলে দেখি আর নিজের জন্য আফসোস করি। গরিব বলে এবং নিজের চাচা-খালু না থাকায় আমি একটি প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড পর্যন্ত পেলাম না।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঘোড়াঘাট পৌরসভার মেয়র আব্দুস সাত্তার মিলন বলেন, ‘আমি একাধিকবার তাকে জন্মনিবন্ধন করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছিলাম। একটি জন্মনিবন্ধন করতে বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টস জমা দিতে হয়। কিন্তু সে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম এখন সরাসরি অনলাইন প্রক্রিয়াতে চলে গিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘অনলাইনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাবমিট করতে না পারলে জন্মনিবন্ধন করা সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়াতে আমাদের কোনো হাত নেই। আবার জন্মনিবন্ধন বা এনআইডি কার্ড না থাকায় সে প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও তাকে আমরা কোনো সরকারি সহায়তা দিতে পারিনি।’
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শাহজাহান মানিক বলেন, ‘মারুফসহ আরও দুজন প্রতিবন্ধীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমরা গত মাসের ২৪ তারিখে দ্বিতীয় দফায় কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছি। এর আগে তারা কেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি, তা আমার জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘গত মার্চ মাসে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আমাকে অবহিত করে যে, মারুফ নামে একজন প্রতিবন্ধী ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে পারেনি। ফলে সে সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরে আমি নিজ উদ্যোগে মারুফকে অফিসে ডেকে নিয়ে তার ছবি নিয়েছি।’
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শাহজাহান আরও বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুমোদন পেলেই আমরা তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবো এবং ভোটার আইডি কার্ড তাদের হাতে তুলে দিতে পারবো। আশা করছি, আগামী এক মাসের মধ্যেই তারা ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে পারবে।’
এমদাদুল হক মিলন/এমআরআর/এমএস