সজীব ওয়াফি
Advertisement
বাংলাদেশ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে বাধ্য হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু বন্ধ করে দিতে হয়। কয়েকদিন যেতে না যেতেই গরিব মানুষের ভোগান্তির বিষয় চিন্তা করে ইচ্ছার বিপরীতে বিধিনিষেধ কিছুটা শিথিল হয়ে পরে। অর্থনীতি সচল রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মনে চলবে শর্তে অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোকে খুলে দেয়া হয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাগম ঠেকানো যাবে না এবং স্কুলের ছাত্রদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বিবেচনা করে নিতে হয় দীর্ঘমেয়াদী বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত।
ঈদের পরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনা আক্রান্তের হার অস্বাভাবিক রকমের বাড়তেছে। দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেই মুহূর্তে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট প্রবেশ করেছে ঠিক সেই মুহূর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিতে শিক্ষার্থীরা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এর একমাত্র বড় কারণ দীর্ঘ দিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা হতাশ। বড় ধরনের ঢেউ শুরু হবে হবে এমন সময়ে শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে সংহতি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক এবং বিশিষ্টজনেরা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার শুরুর দিকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলে ভালোই চলেছে। তখন শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে আগ্রহ ছিল। প্রযুক্তি এবং নেটওয়ার্কের কারণে গ্রাম এবং শহরের শিক্ষার্থীদের ভিতরে একটা বৈষম্যও ছুঁয়েছিল। ১০% শিক্ষার্থীর ডিভাইস সমস্যা সমাধান করা যেত ছাত্র কল্যাণ তহবিল থেকে। অল্প খরচে ক্লাসে না গিয়েও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা সম্ভব। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে বিরাজমান ছিল অবহেলা এবং ফাঁকিবাজি অবস্থা। শিক্ষকদের ভিতরেও এক ধরনের অনাগ্রহ ছাড়া অন্য সমস্যা প্রাধান্য পায়নি। শেষ দিকে এসে অনুপস্থিতির হারও আশঙ্কাজনক বেড়েছে! অথচ নানান সমস্যার ভিতরেই আমাদের প্রযুক্তি সচল করা অসম্ভব ছিল না।
Advertisement
বিশিষ্টজনেরা দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়েছেন। ছাত্ররা গেমস খেলে, ফেসবুক আইডি চালায় এমনটাও নির্দিষ্ট করে বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে সারা পৃথিবী জুড়েই মানুষ হতাশায় পড়েছেন, যেটার প্রভাব পড়েছে আমাদের উপরেও। শিক্ষকেরাও তাদের পূর্বেকার চাঞ্চল্যকর পরিবেশ অনুপস্থিতির অবসাদের অবসান ঘটাতে চাচ্ছেন। ছাত্ররাও মনে করছেন তারা পাস করে বের না হতে পারায় কর্মসংস্থানে ঢুকতে দেরি হচ্ছে, অনিশ্চিত হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশ করোনা পূর্বেই শিক্ষিত বেকার ছিলো ২৬ লক্ষ, করোনায় অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করেছে তারাই চাকরি পাচ্ছে না এবং কর্মসংস্থান রিক্রুট প্রক্রিয়াও যে স্থগিত আছে এটা তাদের কে বোঝাবে!
প্রতিবাদ সমাবেশে শিক্ষক এবং বিরোধী রাজনীতিবিদেরা বলেছেন ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউন দেয়ায় সেখানকার কিছু লোকজন সন্দেহ করেছে আমের বাজার ধ্বংস করার চক্রান্ত! অন্যদিকে ঈদের সময়েই শপিংমল গুলোতেও ভিড় এড়ানো যায়নি। এমনকি বাস বন্ধ করে দিয়েও বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল ঠেকানো অসম্ভব হয়েছে। মানুষের ভিতরে গণসচেতনতা-স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা একেবারেই ছিল না। গরিব মানুষের করোনা হয় না বলাবলি করেও পরিণত হয়েছে ঠাট্টা-তামাশায়। অর্থাৎ আমাদের বিশিষ্টজনদের ভিতরে সন্দেহ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে আন্দোলন করে উল্টে দিবে প্রবণতায় ধরেছে।
উদ্বেগের বিষয় হওয়া উচিত ছিল বৃহৎ সীমাবদ্ধতার মধ্যে কিভাবে সর্বোচ্চটুকু অর্জন করা যায়। মারিকালীন সময়টুকুতে বিরোধী মতের সকলকে অন্তত উচিত ছিল জনস্বার্থে সরকারের সহযোগী হওয়া। উপরন্তু আমাদের বিশিষ্টজনেরা, আমাদের বিরোধী রাজনৈতিকেরা, আমাদের শিক্ষাবিদেরা শিক্ষার্থীদের আবেগের জায়গাটা বুঝলেন; বাস্তবতা উপলব্ধি না করে শিক্ষার্থীদের অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেয়ার পক্ষ নিলেন অবিবেচকের মত। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সকলের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি নেই তার জন্য তারা উদ্বিগ্ন হলেন না কেন!
জটিলতাপূর্ণ এই সময়ে দেশের শিক্ষাবিদদের ক্যাম্পাস খোলার পক্ষে অবস্থান না নিয়ে বিবেচনা করা উচিত ছিল ক্যাম্পাস বন্ধ রেখেও কোন পথে শিক্ষা ব্যবস্থা সচল রাখা যায়। সশরীরে উপস্থিত না হয়ে সকল শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তির আওতায় এনে অনলাইনে ক্রিয়েটিভ প্রশ্নের মাধ্যমে পরীক্ষা নেয়ার সুপারিশ করতে পারতো। যেখানে মিনিমাম ক্লাস শেষ হলে পরীক্ষার রুটিন অনুযায়ী পরীক্ষা কমিটি ছাত্রদের জন্য প্রশ্ন তৈরি করে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে পরীক্ষা নিবেন। নির্দিষ্ট সময়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন পাবে এবং নিজেরা পরীক্ষার খাতা তৈরি করে নির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে উত্তর লিখে সেটার পিডিএফ তৈরি করে জমা দিবে। শিক্ষক পিডিএফ খাতার মূল্যায়ন করবেন এবং ফল প্রকাশ হবে।
Advertisement
ছাত্রকে তার ক্লাসের সময়ে গুরুত্ব দিতে, সঠিকভাবে ক্লাস না করলে ইন্টারনাল মার্কস কাটা'র ব্যবস্থা করা, শিক্ষকেরা অবহেলা করলে তাকেও শাস্তির আওতায় আনা নিয়ে কথা বলা সচেতন রাজনীতিবিদের দায়িত্ব ছিল। স্কুল কলেজের ছাত্রদের অনলাইনে ক্লাসের পাশাপাশি ভিন্ন ভিন্ন এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা ছিল যুক্তিযুক্ত। চাকরির পরীক্ষাগুলোও যথাসম্ভব ক্রিয়েটিভ মূল্যায়নের মাধ্যমে অনলাইনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। উপর্যুপরি আহ্বান করে মূল্যায়নের মাধ্যমে সরকারি আওতায় এনে অর্থ সহযোগিতা দিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে প্রবেশ করানো জরুরি যে সকল মানুষ চাকরি হারা হয়েছেন। সাথে সাথে করোনাকালীন সময়টা লুপ্ত বছর হিসেবে সমন্বয় (যারা চাকরিতে প্রবেশ করেননি) যথাযথ পদক্ষেপ। বিরোধী মহল এই দাবিগুলো করবেন না, তারা স্বাস্থবিধি ভঙ্গকারী আন্দোলনকারীদের পক্ষ নিলেন। উস্কে দিলেন কিভাবে সরকার এবং রাষ্ট্রকে পর্যুদস্ত করা যায়।
আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলে বর্তমান আক্রান্তের ঊর্ধ্বমুখী চাপ সামলাল দেয়া জটিল হয়ে দাঁড়াবে। হিমশিম খেতে হবে মরার লড়াই রুখতে। মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে ভবিষ্যত প্রজন্ম টিকিয়ে রাখার। একজন শিক্ষার্থীর আক্রান্ত অথবা মৃত্যু ঘটলে তার দায় নেয়ার সৎসাহস কি আমাদের বিরোধী দলীয় রাজনীতিকদের, শিক্ষাবিদদের এবং বিশিষ্টজনদের আছে? নাকি তখন সরকারের উপরে দায় চাপিয়ে খালাস হবেন?
প্রকৃতির বিপরীতে অবস্থান নিয়ে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য দাঁড়াচ্ছেন তারা আবেগে ভাসছেন অথবা রাজনৈতিক কারণে। বাস্তবতায় তলিয়ে দেখছেন খুব কম জনই। সব সেক্টর খুলে দিয়েছে অজুহাত দেখিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও একজন ছাত্রের মৃত্যুর দায় নেয়ার মত সৎসাহস আসলে কারোই নেই। জোড়াতালি দিয়ে চলা বাংলাদেশে অসচেতনতায় একবার বড় ধরনের ঢেউ শুরু হয়ে গেলে জীবনের সবকিছু ভেসে যাবে। জনগণ বাঁচিয়ে রাখতে সরকারকে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। দায়-দায়িত্ব নিয়ে বাস্তবতায় চর্চা করতে সকলকে অনুরোধ। ভবিষ্যত প্রজন্ম টিকিয়ে রাখতে এখনই সময় উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার। নয়তো নিজেকে পরিবর্তন করে কার্বোনিফারস সময়ের তেলাপোকা টিকে থাকবে আর সভ্যতা তলিয়ে যাবে!
এইচআর/জেআইএম