বিশেষ প্রতিবেদন

কোটি টাকায় জিম খুলে এখন ঋণ করছেন মালিকরা

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের প্রায় তিন হাজার জিম বা ব্যায়ামাগারের মালিকদের দুর্দিন যাচ্ছে। অনেকে কোটি টাকা দিয়ে জিম খুলেও ব্যবসা করতে পারছেন না। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে গত দেড় বছর ধরেই তাদের এ অবস্থা। শারীরিক গঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ব্যায়াম একটি ভালো পন্থা হলেও এ ব্যাপারে কোনো মন্ত্রণালয়ের মনোযোগ নেই। সরকার অন্যান্য সেক্টরে প্রণোদনা দিলেও জিমের মালিকরা তা পাননি।

Advertisement

অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ যদি নিয়মিত ব্যায়াম করার সুযোগ পান তাহলে অনেক কম অসুস্থ হবেন। এতে করে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয়ও কমে যাবে।

ব্যায়ামের উপকারিতা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম জাগো নিউজকে বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমরা যে জীবন যাপন করছি, তা সবার মধ্যে স্ট্রেস (মানসিক চাপ) তৈরি করে। এই স্ট্রেসের কারণে আমাদের শরীরের হরমোন স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারে না। হরমোনাল অনেক পরিবর্তন এসে যায়। এতে আমাদের শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ব্যায়াম করলে হরমোনাল ইমব্যালান্স অনেকটাই নরমাল হয়ে ফিরে আসে। এতে আমাদের স্ট্রেস কমে যায়। এটা হলো ব্যায়ামের সবচেয়ে বড় উপহার। এছাড়া ব্যায়াম করলে শারীরিকভাবে ফিট থাকা যায়, রোগ-বালাইও কম হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকে ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কিন্তু করোনার ভয়ে আবার জিমেও যেতে পারছেন না। ব্যায়ামের সরঞ্জামাদি কিনে যে বাসাতেই জিম করবেন তাও পারছেন না। কারণ চীন থেকে আসা এসব সরঞ্জাম বাংলাদেশে কয়েকগুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অতিরিক্ত শুল্কের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

Advertisement

এদিকে করোনার কারণে শুরুতে বেশ কয়েক মাস জিম বন্ধ রাখা হয়। এখন নানা বিধিনিষেধ মেনে জিম চালু রাখা হচ্ছে। আগের মতো অনেকে একসঙ্গে জিম করতে পারছেন না। এছাড়া জিমের মালিকদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনা থেকে শুরু করে করোনারোধে নানা পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। কম সংখ্যক সদস্য জিমে এলেও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে বেশি খরচ করতে হচ্ছে মালিকদের।

অন্যদিকে ব্যায়ামের বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাকি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন, এ নিয়ে দুই পক্ষের বিপরীতমুখী বক্তব্য পাওয়া গেছে। ব্যায়ামাগার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও জানেন না এটা আসলে কোন মন্ত্রণালয়ের অধীন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে ২০টির মতো সিটি করপোরেশনের জিম রয়েছে। যা আগে সিটি করপোরেশনই দেখভাল করতো। কিন্তু ব্যবস্থাপনা খারাপ হওয়ায় জিমগুলো এখন লিজ দেয়া হয়েছে। তাই সেগুলোও ব্যক্তিমালিকানায় চলছে। তবে অন্যান্য জিমের তুলনায় এসব জিমের মাসিক ফি কম। তাই সুযোগ-সুবিধাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম।

ঢাকা জিম ওনার’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের সভাপতি এবং টানা ১১ বার মিস্টার বাংলাদেশ খেতাবজয়ী আলতাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন সাধারণ মানের একটি জিম দিতে গেলে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ টাকা ছাড়া হয় না। আর ভালো মানের জিম দিলে ৭৫ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লাগে। কিছুদিন আগে বাড্ডায় এক কোটি টাকা দিয়ে একটা জিম খোলা হয়েছে। এই করোনার সময় এক কোটি টাকা ইনভেস্ট করে কীভাবে লাভ হবে আমার মাথায় আসে না।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘লকডাউন চলাকালে সব জিম বন্ধ ছিল। আমাদের ব্যবসা এখন এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে যে ভাড়া তো দেয়া পরের কথা, নিজের পুঁজি থেকে খরচ করতে হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন খাতে অনুদান দিলেও আমাদের এখানে কোনো অনুদান দিয়েছে বলে আমার জানা নেই।’

উত্তর বাড্ডার জনি গোল্ডেন জিমের স্বত্বাধিকারী জনি আহমদ বলেন, ‘জিম যে শুধু ব্যবসার জন্য তা নয়। এটা স্বাস্থ্য ভালো রাখার অনন্য উপায়। করোনাকে ঠেকাতে হলে কিংবা করোনা যেন সহজেই আক্রান্ত করতে না পারে সেজন্য জিম করা খুবই জরুরি। জিম করলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। তাই সুস্থ থাকার জন্য বেস্ট ওয়ে হচ্ছে জিম। তবে করোনার এই সময় বেশি মানুষ এলে কিন্তু আবার ক্ষতি। এজন্য আমরা ধাপে ধাপে জিম চালাচ্ছি। যেখানে আগে একটি জিমে ১৬ থেকে ২০ জন জিম করতো এখন সেখানে ছয় থেকে সাতজন করে জিম করাচ্ছি।’

গুলশানের একটি জিমের স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে জিম চালাচ্ছি। ব্যবসা খারাপ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বিধিনিষেধের কারণে ব্যবসা প্রায় বন্ধ। বাড়ি ভাড়া দিতে পারিনি। বউয়ের বান্ধবীর কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে।’

গুলিস্তানের জিম ইনস্ট্রুমেন্টের দোকানগুলো ঘুরে গেছে, দ্বিতীয় দফার বিধিনিষেধের মধ্যে কিছুদিন আগে দোকানপাট খুলে দেয়ার পর ক্রেতা সমাগম বেড়েছে। বাসা বাড়িতে ওয়ার্ক আউট করার জন্য মূলত ইনস্ট্রুমেন্ট কেনার জন্য ক্রেতারা এখানে আসছেন। ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, বাড়তি মেদ ঝরানো, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ট্রেডমিলের প্রতি তাদের আগ্রহ বেশি। তবে তরুণরা ডাম্বেল, বার্বেলের প্রতি আগ্রহী। যা কেজি হিসেবে বিক্রি হয়। এছাড়া রিস্ট ব্যান্ড, হেড ব্যান্ড, কোমরের বেল্ট, গ্লাভস, স্টপ ওয়াচ, অ্যাক্টিভিটি ট্র্যাকার, জুতা ও মোজা, আর্ম ব্যান্ড, ম্যাটও ক্রেতারা নেড়ে-চেড়ে দেখছেন।

গুলিস্তানের জহুরুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের দোকানে ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকার ইন্সট্রুমেন্ট আছে। কিন্তু বিক্রি নেই। বাংলাদেশে মূলত চীন থেকে জিমের ইন্সট্রুমেন্ট আনা হয়। চীনের চেয়ে তিনগুণ দামে আমরা ইনস্ট্রুমেন্ট কিনি। যারা এসব মেশিন আনে, তারা বলে শুল্ক এবং কার্গো চার্জ অনেক বেশি। করোনা এখন ফিক্সড হয়ে গেছে। আগামী পাঁচ-সাত বছরে যাবে কি-না তার কোনো ঠিক নেই। এসব ইকুইপমেন্ট আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমানো দরকার।’

দেশে প্রথম নারী বডি বিল্ডিং চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী অহনা রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘করোনাকালে আমাদের লস অবশ্যই হচ্ছে। আগে আমাদের যেমন উপস্থিতি ছিল এখন তেমন নেই। তবে যদি শুধু নারীদের ক্ষেত্রে বলি, অনেকেই জিম করে সন্তান ধারণের সক্ষমতা অর্জন করেছেন। আমাদের কাছে অনেক নারী আসেন যারা কনসিভ করতে পারেননি এবং জিম করার পর অনেকেরই বাচ্চা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ওভারওয়েট মেয়েদের হরমোনাল অনেক সমস্যা থাকে। তাই জিম করলে সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই কেউ যদি ঠিকভাবে ওয়ার্ক আউট করে এবং খাওয়া-দাওয়া মেইনটেইন করে তাহলে হরমোন অনেকটা ঠিক হয়ে যায়। তাই এ বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই নজর দিতে হবে। কেউ জিম করলে শুধু হরমোন না, বডির সবগুলো অর্গান প্রোপারলি কাজ করবে। আর বডির সবগুলো অর্গান প্রোপারলি কাজ করলে যাদের সন্তান হয় না, তাদের সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ জাহিদ আহসান রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘জিমের মালিক নিয়ে আমরা কী করব।’

জিম তো একটি শারীরিক কসরত, এটি খেলার অংশ কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না না, জিম ক্রীড়ার মধ্যে পড়ে না। এটা স্বাস্থ্য রিল্যাটেড। যে কেউ সুস্থ থাকার জন্য এটা করে। আমরা খেলাধুলার জন্য যে জিম ইউজ করি সেটা একটা জিনিস। আর ওটা একটা জিনিস। এ বিষয়ে কিছু হলে স্বাস্থ্য বিভাগে আবেদন করতে বলেন।’

তবে বাংলাদেশ বডি বিল্ডিং ফেডারেশনের নির্বাহী সদস্য নুরুল ইসলাম খান নাইম বলেন, ‘আমাদের ফেডারেশন ক্রীড়া ও যুব মন্ত্রণালয়ের অধীন। খেলার সবগুলো ফেডারেশনই এই মন্ত্রণালয়ের অধীন। কেবল আমরা জিমগুলো দেখভাল বা মনিটরিং করি না। আমরা শুধু বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করি। তবে জিমের অন্যান্য বিষয়গুলো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত। কিন্তু তারাও এর দায়িত্ব নিতে চান না। আর সরকার থেকে প্রণোদনা নেয়ার জন্য যে ধরনের ডকুমেন্ট দরকার, অনেকেরই নেই। আর জিমের মালিকগুলোও তেমন অরগানাইজড না।’

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম-সচিব বলেন, ‘জিম কোন সংস্থা দেখবে তা এখনো হয়তো নির্ধারণ হয়নি। জিমের মালিক এবং এ সংক্রান্ত সরঞ্জামাদি বিক্রেতারা এখনো জোটবদ্ধ নন। তাদের কোনো দাবি-দাওয়াও আমরা পাইনি।’

এইচএস/এমআরআর/এইচএ/জেআইএম