এ এস এম জহির উদ্দিন আকন বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জে ১৯৭১ সালের ১ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম মো. ইলিয়াছ আকন ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মা সেলিমা খানম গৃহিণী। জহির ১৯৮৭ সালে বরিশালের গৌরনদী সরিকল ম্যাধমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৮৯ সালে সরকারি গৌরনদী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। এরপর বরিশালের বিএম কলেজ থেকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগে ১৯৯৩ সালে স্নাতক ও ১৯৯৪ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। জহির উদ্দিন আকন ২০১৯ সালে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন।
Advertisement
তার কর্মময় জীবনের চ্যালেঞ্জ, সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে? জহির উদ্দিন আকন: বাল্যজীবন কেটেছে গ্রামীণ পরিবেশে প্রকৃতির মধ্যে। আমাদের ছোটবেলায় গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতেই ছিল ছোট একটি গ্রামীণ বন। এ বনে ফলদ, কাষ্ঠল গাছ ছাড়াও ছিল প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অনেক পশু-পাখির আবাস উপযোগী গাছ, ঝোঁপ, লতা-আগাছা ইত্যাদি। ছোটবেলায় সুযোগ পেলেই এসব বন-বাঁদাড়ে দৌড়-ঝাঁপ ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক কাজ।
জাগো নিউজ: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?জহির উদ্দিন আকন: ছোটবেলায় পড়াশোনার প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। কিন্তু পড়াশোনার উপকরণের ঘাটতি ছিল প্রকট। পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়া যায় এমন কোনো বই কোথাও পাওয়া যেতে পারে, তা জানতাম না। হাই স্কুল জীবনে পাঠ্যবইয়ের বাইরে হাতেগোনা কয়েকটি বই পড়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। আর পাঠ্যবই অধ্যয়নে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে হাতের কাছে কাউকে পাওয়া যেত না তা সমাধানের জন্য। অবশ্য এতে একটি বড় সুবিধা হতো, তা হলো- সমস্যাটি নিয়ে নিজস্ব সমাধানের চেষ্টা চলতো। যা অনেক ক্ষেত্রেই মেধার বিকাশ সাধন করতো। বাবা-মা পড়াশোনার মাধ্যমে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। স্কুল শিক্ষক হিসেবে বাবার স্বল্প আয় লেখাপড়ার জন্য কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি।
Advertisement
জাগো নিউজ: কখনো কি স্বপ্ন দেখেছিলেন বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করবেন?জহির উদ্দিন আকন: বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজকে ঠিক স্বপ্ন হিসেবে না দেখলেও প্রকৃতি তথা বন্যপ্রাণির আবাসস্থল উন্নয়নে ছোটবেলা থেকেই কাজ করে আসছি। বিশেষ করে বন্যপ্রাণির খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত বট, পাকুড়, ডুমুর, ডেউয়া, দেশিগাব, জিবন ইত্যাদি গাছ জন্মানোর চেষ্টা ছোটবেলা থেকেই অব্যাহতভাবে চালিয়ে আসছি। যখনই সুযোগ হয়েছে, একটি গাছ লাগিয়েছি কিংবা একটি গছের যত্ন নিয়েছি, যা মানুষের চেয়ে পশু-পাখির কল্যাণে বেশি কাজে এসেছে।
জাগো নিউজ: আপনি বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক। চ্যালেঞ্জিং এ কর্মজীবনের গল্প শুনতে চাই—জহির উদ্দিন আকন: বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালকের দায়িত্বের অধিক্ষেত্র সমগ্র বাংলাদেশ। দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রথমেই আমার ইউনিটের এগারো জন লোকবল দেখে মারাত্মক হতাশ হয়ে যাই। অধিকন্তু ইউনিটে কাজ করার জন্য কোনো যানবাহন নেই, যা আমাকে আরও দুর্বল করে দেয়। বন্যপ্রাণি অপরাধের কাজ করতে গিয়ে দেখি অপরাধ সংঘঠিত হয় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে কিভাবে পৌঁছাবো, কিভাবে সেবা দেব, কিভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াবো- ভাবনাটি প্রথমদিকে আমাকে খুব বেশি বেদনা মথিত করে দিত। প্রথমদিকে সমস্যাগুলোকে খুব বেশি করে দেখতাম। সমস্যা সমাধানের বিশেষ কোনো উপায় পেতাম না। কেননা বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটটি ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনটি পাস হওয়ার পরে প্রকল্পের আওতাধীনে কার্যক্রম শুরু করলেও এবং সে অবধি ইউনিটটি প্রকল্পের আওতায় চললেও এখানে সরকার কাউকে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য নিযুক্ত করেননি। কাজেই সে হিসেবে পূর্বসূরিরও বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা আমাকে পথ দেখায়নি।
কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর সমস্যাগুলো সমাধানের নিজস্ব উপায় খুঁজতে থাকলাম। প্রথমেই বন্যপ্রাণি অপরাধের তথ্য প্রাপ্তির বিষয়ে নিজস্ব ফেসবুক প্রোফাইলকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করলাম। মোবাইল নাম্বারকে হটলাইন নাম্বার ঘোষণা করে ফেসবুকে সারাদেশে বন্যপ্রাণি অপরাধের তথ্য জানানোর আহ্বান জানাই। এরপর জাতীয় জরুরি কল সেন্টার ৯৯৯-এ নিজের এবং ইউনিটের কয়েকজনের নাম্বারকে সংযুক্ত করার ব্যবস্থা করি। সেইসঙ্গে সামাজিক মিডিয়ায় নিজেকে এবং ইউনিটের সবাইকে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করি। এছাড়াও নিজের এবং ইউনিটের সবার মোবাইল নাম্বার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে যেখানেই সুযোগ সৃষ্টি হয়; সেখানেই ভিজিটিং কার্ড বিলি করার ব্যবস্থা করি।
অল্প কিছুদিন যেতে না যেতেই সারাদেশ থেকে বন্যপ্রাণি অপরাধের তথ্য প্রাপ্তির সমস্যাটা সমাধান করতে পারলাম। কিন্তু তথ্য প্রাপ্তির সাথে সেবা প্রদানের চ্যালেঞ্জটি প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হলো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বন্যপ্রাণি অপরাধ দমনের টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। কাজেই এ সমস্যা সমাধানের জন্য ইউনিটের সব সদস্যকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্যপ্রাণি অপরাধের তথ্য প্রাপ্তির পর প্রতিটি তথ্যকে অত্যন্ত আন্তরিকভাবে গ্রহণ করার। তথ্য প্রদানকারীর মোবাইলে প্রয়োজনে ফোন ব্যাক করে সমস্যা বিস্তারিতভাবে জেনে তথ্য প্রদানকারীর মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে তাকে সন্তুষ্ট করতে। এ ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান করা না গেলে চেষ্টা করা হয় স্থানীয় বন বিভাগ, এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন কিংবা ওই এলাকায় বিদ্যমান স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের। দেখা গেছে, উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় প্রায় শতভাগ সমস্যারই সমাধান করা সম্ভব হয়। আর এভাবেও যদি সমস্যার সমাধান করা না যায়, তখন বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটের টিম সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়।
Advertisement
তৃতীয় চ্যালেঞ্জিং কাজটি হলো বন্যপ্রাণি অপরাধের তথ্য প্রদানকারীদের সমন্বিত করা। তাদের এ কল্যাণকর চিন্তাটিকে জীবনের প্রাত্যহিক অভ্যাসে পরিণত করা। এ জন্য প্রত্যেকটি উপজেলায় এদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আওতায় সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ। এ জন্য তথ্য প্রদানকারীদের সাথে ধারাবাহিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিটকে রাজস্ব খাতের আওতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। কেননা রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্তি ছাড়া ইউনিটের কাজকে টেকসই ও গতিশীল করা কখনোই সম্ভব নয়।
জাগো নিউজ: কর্মজীবনে কার কার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?জহির উদ্দিন আকন: কর্মজীবনে দায়িত্বানুভূতিকে কাজের প্রেরণা হিসেবে নিয়েছি। কাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা দায়িত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
জাগো নিউজ: বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিট কোন কোন বিষয়ে কাজ করে?জহির উদ্দিন আকন: বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন ইউনিট বন ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ, বন্যপ্রাণি অপরাধ দমন, বন্যপ্রাণি বিষয়ক জনসচেতনতা সৃষ্টি, এলাকাভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি, যুবসমাজকে সংগঠিত করা প্রভৃতি কাজ করে যাচ্ছে।
জাগো নিউজ: বন্যপ্রাণি আইন সবার কাছে কীভাবে পৌঁছানো যায়?জহির উদ্দিন আকন: বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ বাংলাদেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রথমেই এ বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ও আইন সম্পর্কে বেসিক ধারণা প্রদান করতে হবে। মসজিদের ইমাম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পুরোহিত বা ধর্মগুরুদের এ আইন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে পারলে, তারাও সাধারণ মানুষকে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে উপদেশ দিতে পারবেন। সর্বোপরি এ কাজে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে (আইনটি সবার কাছে পৌঁছাতে) বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আর এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারলে অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের এ আইনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সব মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
জাগো নিউজ: প্রত্যন্ত অঞ্চলে কতটুকু কার্যকর এ আইন?জহির উদ্দিন আকন: প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাদেশের বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ এর গুরুত্ব এখনো সঠিকভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। বন্যপ্রাণি সংরক্ষণই এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য। কাজেই ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এ দেশের সর্বস্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করার কাজ এখনো অনেক বাকি।
জাগো নিউজ: আপনার কাজ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?জহির উদ্দিন আকন: ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসমূহের মধ্যে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া, বন্যপ্রাণি বিষয়ক সচেতনতামূলক লিফলেট, পোস্টার, বুকলেট এবং স্টিকার বিতরণ, যুবসমাজকে সংগঠিত করে বাংলাদেশের সব জেলা এবং উপজেলায় বন্যপ্রাণি ও পরিবেশ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি করা, পশু-পাখির জন্য উপযুক্ত গাছ-পালা লাগানো, সরকারি দফতর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ ও আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান এবং মসজিদের ইমাম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের পুরোহিত বা ধর্মগুরুদের এ আইন সম্পর্কে সচেতন করে তোলা।
এসইউ/জিকেএস