অর্থনীতি

দুগ্ধশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা দূরে নয়

দেশে চাহিদার দিক থেকে মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতার পরিমাণ এখনো কম। তবে গত কয়েক বছরে দুধের উৎপাদন বেড়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকার খামারগুলোতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে যে হারে দুধের উৎপাদন বেড়েছে, তাতে দুগ্ধশিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বেশি দূরে নয়।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কমপক্ষে ২৫০ মিলিলিটার দুধ খেতে বলছে। কিন্তু দেশে এখন মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতা ১৭০ থেকে ১৭৫ মিলিলিটারের মধ্যে। তবে গত এক দশকে দেশে দুধের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ। এর মধ্যে শেষ পাঁচ বছরে বেড়েছে ৩০ হাজার কোটি লিটার। উৎপাদনের এমন ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ৪ থেকে ৬ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য দেশে দুধের উৎপাদন দেড় কোটি লিটারের কাছাকাছি নিতে হবে। দেশে গত অর্থবছরে দুধের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৬ লাখ ৮০ হাজার টনে। অর্থাৎ, চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি দুধ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। তার আগের বছর (২০১৮-১৯ অর্থবছরে) দেশে দুধ উৎপাদন হয়েছিল ৯৯ লাখ টন, যা মোট চাহিদার ৬৫ শতাংশ। আর চলতি বছর উৎপাদন ১ কোটি ২০ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এসব বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) পরিচালক (পুষ্টি) ড. মো. মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দেশে দুধের উৎপাদন যে হারে বেড়েছে, সেটা অব্যাহত থাকলে দ্রুত স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসবে। সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশকে দুধে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কাজ করছে। আশা করি সেটা সফল হবে। তা না হলেও পরের এক-দুই বছরের মধ্যে নিশ্চয় হবে।

Advertisement

তিনি বলেন, সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি উন্নত জাতের গাভী পালন বৃদ্ধি, বেসরকারি খাতের বড় বিনিয়োগ এবং শিক্ষিত খামারিদের এ খাতে সম্পৃক্ততা একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। এখন গাভী পালন করে একজন মানুষ সহজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন, যা এক দশক আগে ভাবা যায়নি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুবকদের এই খাতে উদ্যোক্তা হিসেবে আসার জন্য উৎসাহ দেয়া যায়। তারা খুব ভালো করছেন।

যদিও দেশীয় চাহিদা পূরণে আমদানি করা গুঁড়া দুধের ওপর এখনো নির্ভরশীলতা রয়েছে। বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে শুধু দুধ আমদানির ক্ষেত্রে।

বিষয়টি উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, দেশে এখন শুধু তরল দুধ বাজারজাত করলেই হবে না। এর ভিন্নতা আনতে হবে। শিশুরা দুধ খেতে চায় না। তাই তাদের জন্য ফ্লেভারড দুধ ও বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে আনা যেতে পারে। অনেকের পেটে দুধ সহ্য হয় না। তাদের জন্য সরাসরি দুধের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত খাবার তৈরি করে বাজারজাত করতে হবে। বিদেশে বিভিন্ন শ্রেণি ও বয়সের মানুষের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রকমের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, ঐতিহ্যবাহী দুগ্ধজাত পণ্য আমরা সনাতন পদ্ধতিতে ভোগ করছি। এগুলোকে স্বাস্থ্যকর উপায়ে তৈরি করে ভোক্তার কাছে সহনীয় দামে পৌঁছে দেয়া সম্ভব। এতে যেমন দুধের চাহিদা বাড়বে, তেমনি ভালো দাম পাবেন খামারিরা।

Advertisement

দুধ উৎপাদনে অনেকে বিদেশি উন্নত জাতের গরু পালন করছেন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সনাতন পদ্ধতিতে গরু পালনে যে ব্যয়, সে তুলনায় দুধ উৎপাদন হচ্ছে না। ফলে অনেক সময় খামারিদের লোকসান হয়। উন্নত জাতের গরু আমদানি বাড়ানো গেলে, একই ব্যয়ে বেশি দুধ উৎপাদন সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে আমাদের দেশেও কিছু উন্নত জাতের গরু পালন করা হচ্ছে। কোনো কোনো জাত এ দেশের পরিবেশের সঙ্গে এখনো খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। তাই সেগুলোর ক্রসব্রিড পালন করছে অনেকে। কেউ কেউ আবার অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে বিদেশি উন্নত জাতের গরু পালন করছে।

খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি শাহ ইমরান জানান, বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে তিন লাখ দুগ্ধ খামার রয়েছে, যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। প্রতিদিন এসব খামারে গড়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়।

তিনি জানান, দেশের দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতের কয়েকটি বড় কোম্পানির প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এর মধ্যে কিছু কোম্পানির গুঁড়া দুধ তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। একই সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২টি কোম্পানি ঘি, মাখন, ফ্লেভারড মিল্ক, আইসক্রিম ও ক্রিম তৈরি করে। তারপরও সার্বিক উৎপাদনের তুলনায় এ সংগ্রহের পরিমাণ অনেক কম। এ খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।

এক দশকে দুধ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় সাড়ে তিন গুণ

শাহ ইমরান বলেন, দুধের উৎপাদন আরও দ্রুত বাড়াতে চাইলে দেশে গুঁড়া দুধ আমদানি বন্ধ করতে হবে। তাহলে চাহিদার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন বাড়বে। এছাড়া দুধ সম্পর্কে অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সেসব অপপ্রচার বন্ধ করতে হবে। দুধ খাওয়ার জন্য প্রচারণা বাড়াতে হবে।

কয়েকজন খামারির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যন্ত এলাকায় চাহিদার বাড়তি দুধ দোহনের পর চিলিং সেন্টারে পাঠাতে অনেক সময় লাগে। অনেক এলাকায় চিলিং সেন্টার নেই। এক্ষেত্রে দুধের মান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সংগ্রহ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। তাহলেই মানসম্পন্ন দুধ উৎপাদন ও দুধ নষ্ট হওয়া ঠেকানো সম্ভব। তাই বর্তমানে দুধ ও দুগ্ধজাতীয় পণ্য মজুতের ব্যবস্থা করলে, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের পাশাপাশি দেশের খামারশিল্পকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে।

বাড়ছে দুধের বাজার

এক সময় হাটে ও বাড়িতে গোয়ালার কাছে দুধ মিলতো। সেটাই ছিল দুধের সার্বিক বাজার। কিন্তু এক দশকে বেসরকারি কোম্পানির বিনিয়োগে দুধের বড় বাজার তৈরি হয়েছে। হাতের কাছে পাস্তুরিত তরল দুধ, ইউএইচটি (আলট্রা হাই টেম্পারেচার) তরল দুধ ও গুঁড়া দুধ পৌঁছে দেয় কোম্পানিগুলো।

দুগ্ধ খামারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ

মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) নিবন্ধিত ১৪টি দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানি রয়েছে। এর বাইরে আরও ডজন খানেক কোম্পানি আছে।

বড় কোম্পানির মধ্যে প্রাণ ডেইরি, ব্র্যাক ডেইরি ও আকিজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ইউএইচটি প্ল্যান্ট রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাণ ডেইরির হিস্যা ৮০ শতাংশের মতো। দেশে বছরে ইউএইচটি দুধের বাজার ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে।

সম্ভাবনার বাজার ইউএইচটি

কয়েক বছর ধরে উচ্চ তাপমাত্রা বা আলট্রা হাই টেম্পারেচার (ইউএইচটি) পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া করে দুধ বাজারজাত শুরু হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে ইউএইচটি দুধের চাহিদা বাড়ছে। কারণ, এই দুধ অধিক স্বাস্থ্যসম্মত।

যথাযথভাবে দুধ মজুতের ব্যবস্থা করলে এ শিল্প এগিয়ে নেয়া সম্ভব

ইউএইচটি পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া করা দুধ ছয় মাস খাওয়ার উপযোগী থাকে। এটি দুধ প্রক্রিয়াকরণের সর্বাধুনিক পদ্ধতি। দেশে তিনটি কোম্পানি এখন এ পদ্ধতিতে দুধ প্রক্রিয়া করে বাজারে ছাড়ছে। দিন দিন এ বাজার বড়ও হচ্ছে।

কোম্পানিগুলো বলছে, ইউএইচটি পদ্ধতিতে কাঁচা দুধকে ১৩৫ থেকে ১৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চার সেকেন্ড উত্তপ্ত করে সম্পূর্ণ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় ছয় স্তরবিশিষ্ট টেট্রা প্যাকের বিশেষ কার্টন প্যাকে বাজারজাত করা হয়।

ইউএইচটি প্রক্রিয়ায় দুধে থাকা রোগ ও পচন সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া এবং পচনকারী উৎসেচক (এনজাইম) শতভাগ ধ্বংস হয়ে যায়। টেট্রা প্যাকের কার্টন ভেদ করে কোনো ধরনের বাতাস, আর্দ্রতা ও সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। তাই নতুন কোনো ব্যাকটেরিয়া দুধের সংস্পর্শে আসতে পারে না। ফলে প্যাকেটজাত দুধ সাধারণ কক্ষ তাপমাত্রায় (২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ছয় মাস পর্যন্ত পানের উপযোগী থাকে। এটি বিশ্বে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচলিত একটি পদ্ধতি।

এনএইচ/এমএসএইচ/জেএইচ/জেআইএম