সাহিত্য

মায়াবতী : পর্ব ০৮

কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের মায়াবতী বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয় মনোবৈজ্ঞানিক উপন্যাস। সাহিত্যের শব্দবিন্যাসে তিনি ব্যবহার করেছেন মনস্তত্ত্ব, সমাজের আড়ালের চিত্র। মা প্রত্যক্ষ করেছেন, মেয়েরা নানাভাবে উৎপীড়ন ও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, সহজে মুগ্ধ হয়ে অবিশ্বাস্য পাতানো ফাঁদে পা দেয়। মায়ের একান্ত চাওয়া মেয়ে ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। বিধিনিষেধ আরোপ করেন মা। মেয়ে তখন মনে করে, মা স্বাধীনতা দিতে চায় না, বিশ্বাস করে না তাকে। মায়ের অবস্থানে মা ভাবছেন তিনি ঠিক। মেয়ের অবস্থানে মেয়ে ভাবছে, সে ঠিক। মায়ের ‘ঠিক’ এবং মেয়ের ‘ঠিক’র মাঝে সংঘাত বাধে। সংঘাত থেকে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, ভুল করে বসে মেয়ে রিয়া। পালিয়ে যায় ঘর থেকে। এই ‘ভুল’ই হচ্ছে উপন্যাসের মূলধারা, মূলস্রোত। মায়াবতী পড়ে চিন্তনের বুননে ইতিবাচক গিঁট দেয়ার কৌশল শেখার আলোয় পাঠক-মন আলোকিত হবে। জানা যাবে টিনএজ সমস্যা মোকাবিলার কৌশল। জাগো নিউজের পাঠকের জন্য ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে সাড়া জাগানো উপন্যাসটি—

Advertisement

দশ.কী-হোলে চোখ রাখল রেজা।

এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তার কোলে ফুটফুটে এক শিশু। তিন মাসের মতো বয়স। শিশুটির গায়ে কোনো কাপড় নেই। কচিশিশু হাত দিচ্ছে কিশোরীটির মুখে। চুল ধরছে। নড়ে নড়ে উঠছে তার দেহ। মাথা। হাত। সব অঙ্গই একসঙ্গে টলে উঠছে।

দরজা খুলে দিল রেজা।

Advertisement

শিশুটি পিটপিট করে রেজার দিকে তাকাতে লাগল। চোখ ধরে রাখতে পারছে না, সরাসরি তাকিয়েও থাকতে পারছে না শিশু, তবু তাকাচ্ছে। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। খলখল করে হাসছে। কলকলিয়ে হাসছে শিশুটি।

রেজার বুকে অনন্য এক শিহরণ জেগে ওঠে।

হাত বাড়াল রেজা। শিশুটি দুহাত ঝাঁকিয়ে লাফ দিতে চায়। খুটখুট করে হাসতে থাকে। তার চোখ হাসে। দেহ হাসে। ঝাঁপাঝাঁপি, হাত ছোড়াছুড়ির মধ্যে আছে হাসির বাঁধভাঙা উল্লাস।

রেজার কোলে চলে এলো শিশুটি।

Advertisement

নরম দেহ। কচি হাত। কচি পা। ছোট্ট শরীর। স্পর্শ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেজার মধ্যে অন্য রেজা জেগে উঠল। নিজের সন্তান নেই। বিয়ে, শিশু, সন্তান, বিষয়টা গোপনে দোলা দিয়ে যায়। শিশুটি ওর মুখ ধরতে চায়। নাক ধরতে চায়। চুল ধরতে চায় রেজার। দেহের মুভমেন্টে এখনো ব্যালান্স তৈরি হয়নি। তাই এদিক-ওদিক তুলতুলে হাতের গুঁতো লাগছে। স্পর্শের আলোড়ন অন্যরকম। রেজা নিজের ভেতর অন্য সত্তার অস্তিত্ব টের পেতে লাগল।

কিশোরীটির দিকে তাকিয়ে রেজা বলে, ওর নাম কী?রইয়ান। রইয়া বলে ডাকে সবাই।বাহ! অন্যরকম নাম! তোমার নাম কী? কিশোরীর দিকে তাকিয়ে আবারও প্রশ্ন করল রেজা।আমার নাম? আমার নাম দিয়া আপনার কী অইবো? কিশোরীটি দেহ মুচড়িয়ে লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দিল।প্রথমে ভেবেছিল এ কিশোরী হয়তো রইয়ার বোন কিংবা ছোটো খালা। পোশাকে পরিপাটি। চুল খোঁপা করা। পরিচ্ছন্ন উজ্জ্বল রঙের চপল কিশোরীটি যে কাজের মেয়ে হতে পারে ভাবতে পারেনি রেজা। কথা আর উচ্চারণ শুনে মনে হলো ও কাজের মেয়ে।

রইয়ার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জেগে উঠল। মেয়েটাকে কাজের মেয়ের মতো রাখেননি। নিজের মেয়ের মতোই রেখেছেন।

মমতার বিনিময়ে মমতা পাওয়া যায়। কিশোরীটাকে রইয়ার মা-বাবা নিশ্চয়ই মমতা দিয়েছে। এ কারণে সে-ও মমতা ঢেলে রইয়ার সঙ্গে হেলেদুলে খেলছে। সাড়া দিচ্ছে। আদর করছে। স্বতঃস্ফূর্ত মমতা পাওয়া কঠিন। মমতা পেতে হলে মমতা দিতে হয়। রইয়ার মা নিশ্চয়ই জানে। সবাই কি জানে কথাটা? রেজার মনে নাড়া খায় মৌলিক মমতার চিহ্ন দেখে।

আবারও ও নরম স্বরে প্রশ্ন করল, তোমার নাম কী?এবার মেয়েটি লাজুক হেসে বলল, আমার নাম বুবলি।গুবলি? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল রেজা। শুনতে ভুল করেছে ও।না না। গুবলি না। বুবলি। বুবলি। বলেই হাসতে লাগল মেয়েটা।অন্য দশ কিশোরীর মতো লাজুক হাসি উথলে উঠল বুবলির চোখেমুখে।তোমার নাম খুব মডার্ন।বুবলি মডার্ন শব্দটি বোঝেনি। না-বুঝে বোকার মতো হেসে ওঠে।নামটা কে রেখেছে?খালামণিই ‘বুবলি’ নাম দিছে। ‘বুবলি’ কইয়া ডাহে।খালামণি? খালামণি নাম দিয়েছেন?হঁ। খালামণি। রইয়ার আম্মু।আচ্ছা, আচ্ছা। রইয়ার আম্মু। তো, তোমার নিজের নাম নাই?আছে। মা নাম রাখছিল ললিতা। মা ললিতা কইয়া ডাহে। খালামণি কয় বুবলি।তোমার নাম বদলাল কেন, জানো?না। জানি না। খালামণি আদর করে। তাই কয় বুবলি।

রেজা বুঝতে পারে। ললিতা একটি বিখ্যাত উপন্যাসের চরিত্র। এই চরিত্রের সঙ্গে জড়িত আছে সেক্সের ছড়াছড়ি। ইচ্ছাকৃতভাবে রইয়ার মা নাম বদলিয়েছেন। বুবলির জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে কাজটা করেছেন।

রইয়ার মায়ের জন্য শ্রদ্ধা জাগল মনে। কিশোরীকে নতুন মোড়কে সাজাতে চান তিনি। এ সাজানোর অপর পিঠে আছে মেয়েটার জন্য শুভকামনা, আপন করে নেওয়ার গোপন ইচ্ছা।

রইয়ার মা-বাবা কী করেন? কোথায় থাকেন? রেজা জানতে চায়।মা কলেজে পড়ায়। বাবা চাকরি করে। এ বিল্ডিংয়ের সামনের ব্লকে থাহে।ওহ! তাহলে তো বেশিরভাগ সময় ওরা বাইরে থাকেন।হঁ।রইয়াকে তুমিই পালছ?

হেসে দেয় বুবলি। হাসির মধ্যে রইয়ার জন্য ঝরে পড়ল গোপন মায়া। প্রশ্নের পুরো জবাব দেয়নি ও। জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। বুবলির প্রকাশভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, শিশুটির পুরো দায়িত্ব পালন করে ও।

তবুও রেজা প্রশ্ন করল, তুমি সব দেখাশোনা করতে পারো?আবারও হাসে বুবলি। বুঝিয়ে দেয় ও পারে। ও মন দিয়ে কাজ করে। শিশুটিকে লালন-পালন করে আনন্দ পায়।রেজা বোঝে, মেয়েটির গুণ আছে। ওর দায়িত্ব পালনে গাফিলতি নেই। কাউকে আপন করে নেওয়ার জন্য আদর দিলে তাকে আপনজনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া যায়। বিশ্বাস করা যায়। রইয়ার মা নিশ্চয়ই সে বিশ্বাস পেয়েছেন। সেই বিশ্বাস অর্জন করেছেন।রইয়ার মায়ের এ অর্জন মুগ্ধ করে রেজাকে।

তুমি কি সারাদিনই ওর সঙ্গে থাক?না, না। খালামণি আইলে আমার কাজ শেষ। খালামণি তহন রইয়ার সঙ্গে থাহে।তুমি আর কী কর বাসায়? রেজা বোঝার চেষ্টা করে, যে কিশোরী মমতা ঢেলে রইয়াকে দেখাশোনা করে তাকে দিয়ে ঘরের অন্য কোনো কাজ করানো হয় কি-না?অন্য কাজ করি না। রান্নাবান্না বুয়া করে। আমি বিহালে বাসায় পড়ি। খালামণি বই কিন্যা দিছে। পড়ি আমি।বাহ্! আবারও মুগ্ধ হয়ে গেল রেজা। আবারও রইয়ার মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল রেজার মন।তোমার মায়ের কথা মনে পড়ে না? হঁ। মনে পড়ে। মাকে দেখতে মন চায়।বাবার কথা?বাবা! বাবা নাই।মারা গেছে?না। মরে নাই। আমার মারে রাইখ্যা পালাইছে। আরেক মাইয়ারে বিয়া করছে। অন্যহানে সংসার পাতছে। বলতে বলতে বুবলির চোখেমুখে ঘৃণা জেগে ওঠে।ও। তোমার তো অনেক কষ্ট তাহলে।না। এইডা এমন কী কষ্ট।কষ্ট না?না। ভালাই অইছে। বাবা খালি মারে মারত। মাইর খাওন থেইকা রেহাই পাইছে মা।তোমাকে দেখতে আসে না বাবা?নাহ্! বাবারে ভুইল্যা গেছি। শক্ত হয়ে জবাব দেয় বুবলি।ওঃ! আর কী কথা বলা যায়। কথা থেমে গেছে। দুঃখ পেয়ে রেজা চুপ হয়ে গেল। রইয়ার নড়াচড়ার দিকে মনোযোগ দিল। রইয়ার হাসির দিকে মনোযোগ দিয়ে সাড়া দিতে লাগল।বুবলি বলল, দেন। রইয়ারে দেন। বলেই হাত বাড়াল।রইয়া ঝাঁকি দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে কেঁদে উঠল। রেজার গলা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতে লাগল।দেখেছ? আমার কাছ থেকে যেতে চায় না।হঁ। রইয়া আপনারে পছন্দ করছে।কেন? পছন্দ করল কেন? আপনি দেখতে রইয়ার আব্বুর মতন।ওহ! রেজার উচ্ছ্বাস থেমে গেল।

পিতৃত্বের অস্তিত্ব জেগে ওঠায় মনে বিষাদ জেগে উঠল। বুবলির বাপের আচরণ মনে কষ্ট ঢেলে দিয়েছে। ‘রইয়ার আব্বুর মতো দেখতে’ শব্দটা আবার কষ্ট মুছে দিয়েছে। শিহরণ জাগিয়েছে। এই শিহরণই আবার কষ্ট ঢেলে দিয়েছে মনে। বিষাদ জাগিয়েছে। বিষাদ মনে বলল, বুবলি, তোমাদের বাড়ি কোথায়?আমাগো ঘর নাই।না। মানে, গ্রামের বাড়ি?গ্রামের বাড়ি নাই। বড় হয়েছ কোথায়?মানিকগঞ্জ।ঢাকায় এলে কীভাবে?মা আনছে। মা আমারে নিয়া ঢাকায় পালায়ে আইছে।কেন, পালিয়েছে কেন?মা কাজ করত চালের আড়তে। আড়তের মালিক একদিন আমাগো বাসায় আহে। মারে কয়, আমারে বিয়া করব। মা ভয় পায়। পালাইছে আমারে লইয়া।ওহ! আবারও ধাক্কা খেল রেজা। বুবলির কথায় জড়তা নেই। হড়বড়িয়ে সব বলে ফেলছে। রেজার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মমতা পেয়েছে। স্নেহ পেয়েছে। রেজার কণ্ঠে স্নেহের আভাস তার মনের তালা খুলে দিয়েছে। তুমি ভয় পাও নাই?না। পাই নাই।কেন? এমন প্রস্তাবে তো ভয় পাওয়ার কথা। আমি পাই নাই। খালি আড়তের মালিক না। যে ব্যাডা আমার দ্যাহে; হে-ই বিয়া করবার চায়। কুমতলব করে। ব্যাডাদের চোখ ছিনি আমি। ভয় পাই না।চোখ চেনো?হঁ। ছিনি। সুযোগ পাইলেই কয়, আমি নাহি সুন্দর। আমার মুখে নাহি খুব মায়া।ওহ! এসব বলার সুযোগ দাও।সুযোগ আবার দেওন লাগে? গেরামে তো কুত্তা-বিড়ালের মতো বড় হইছি। কুত্তা-বিড়ালের কাছে আইতে পুরুষের তো সুযোগ দেওনের দরকার অয় না।

রূঢ় বাস্তবতা বেরিয়ে এলো বুবলির বর্ণনায়।রেজা দমে গেল। এত ছোট মেয়ের এ অভিজ্ঞতা! বুবলিকে ভালো করে দেখে বুঝল আসলেই বুবলি সুন্দরী। মায়াবতী। কৈশোরের দুরন্ত লাবণ্য ছলকে উঠছে তার মুখ থেকে। বিত্তবানের ঘরে মমতা আর আদর পাওয়ার কারণে সেই লাবণ্য বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো উছলে উঠছে। হঠাৎ রেজার চোখ সেই লাবণ্যের দিকে গেল। বুবলিকে আর ছোট্ট কিশোরী মনে হলো না। কাজের মেয়ে মনে হলো না। মনে হলো বুবলির দেহে চিরন্তন রমণীর রমণীয় পাপড়ি পেখম মেলছে।

বুবলির দিকে আবার তাকায় ও। চোখাচোখি হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গেই চোখ নামিয়ে নিল।রেজার বুকে কাঁপন উঠল। বুবলি কি তবে নিজের ভেতরের পুরুষসত্তা চিনে ফেলেছে? ও তো মমতা মেখেই কথা বলছিল। এ মমতার আড়ালে কি তবে গোপন তাড়না বয়ে গেছে নিজের ভেতর? জানে না রেজা। তবে এ মুহূর্তে নিজের কাছে নিজেই পরিচ্ছন্ন ও।

রইয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে বুবলি বলল, দেন, রইয়াকে দেন।রেজা এবার সহজ হয়ে রইয়াকে বুবলির হাতে তুলে দেয়।বুবলি দরজার দিকে এগিয়ে যায়। পেছন ফিরে তাকাল একবার।দেখল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রেজা।ভুরু বাঁকিয়ে, সহজ ভঙ্গিতে বুবলি বলল, যাই।

রেজা মাথা নাড়ে। বুবলি চলে যায়। মায়াবতী বুবলির মায়ার ঢেউ ভাসতে থাকে বাতাসে। কোমল শিশুর কলরোল ভাসতে থাকে রেজার মনের গহিনে।

চলবে...

এসইউ/এএসএম