বাজেট সামনে এলেই নানা খাতের বরাদ্দ নিয়ে কথা হয়, নানা দাবি দাওয়া ওঠে আসে। তার কিছু বাস্তবায়িত হয়, কিছু হয় না। সব খাতেরই নিজস্ব অগ্রাধিকার আছে। সবাই নিজের মন্ত্রণালয়কেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। কিন্তু কখনো কখনো জাতীয়ভাবে অগ্রাধিকার বদলে যায়। যেমন গত দেড়বছর ধরে বাংলাদেশ শুধু নয়, সারাবিশ্বেই সবার নজর স্বাস্থ্য খাতের দিকে। আর এই নজর দিতে গিয়েই দেখা গেল, স্বাস্থ্য খাতেই সবচেয়ে বেশি অস্বাস্থ্যকর কাজ কারবার চলে।
Advertisement
আমাদের দেশে পদে পদে দুর্নীতি- কোথাও কম, কোথাও বেশি। যেখানে দুর্নীতি কম, সেখানে যে ফেরেশতারা বসে আছে, তা কিন্তু নয়। আসলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ কম। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে দুর্নীতি সবচেয়ে বেশি, কারণ এখানে কেনাকাটা বেশি, তাই দুর্নীতির সুযোগও বেশি। তবে আমি ভেবেছিলাম করোনাকালে কেউ অন্তত দুর্নীতি করবে না, লোভ করবে না। এমন বৈশ্বিক মহামারি দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের কারোই নেই। ভেবেছিলাম মৃত্যু ভয় বুঝি আমাদের মানসিকতাই বদলে দেবে। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, করোনার সময়ে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি যেন আরো বেড়েছে। করোনার সময় যখন বেশিরভাগ মানুষের রুটি-রুজিতে টান পড়ছে, তখন কিছু লোক রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়ে গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি রীতিমত রূপকথার মত। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারির হাজার কোটি টাকা, ড্রাইভারের শত কোটি টাকা- এই গল্প তো রূপকথার বইয়েই পাওয়া সম্ভব। আর সম্ভব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি আবজাল, গাড়িচালক মালেকরা সেই রূপকথাকে বাস্তব করেছেন।
স্বাস্থ্যখাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবজাল বা মালেক একজন দুজন নয়, সেখানে আবজাল-মালেকদের ছড়াছড়ি, দুর্নীতিবাজদেরই রাজত্ব। আগেই বলেছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যেহেতু কেনাকাটা বেশি, তাই দুর্নীতিও বেশি। অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনা, বেশি দামে কেনা, এক জিনিস দেয়ার কথা বলে আরেক জিনিস গছিয়ে দেয়া- দুর্নীতি হরেক রকমের মাত্রা আছে স্বাস্থ্য অধিধদপ্তরে। বিভিন্ন হাসপাতালে এমন সব জিনিস কেনা হয়, যা কোনোদিন খোলাই হয় না। দেখা গেল কোনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এমআরআই মেশিন আছে, কিন্তু অপারেটর নাই। ৯ লাখ টাকার জিনিস কেনা হয় ৯০ লাখ টাকায়। বিল করা হয় আমেরিকান পণ্যের, সরবরাহ করা হয় চাইনিজ। ঠিকাদারদের দায়িত্ব গছিয়ে দেয়া।
Advertisement
দৈনিক দেশ রূপান্তরের একটি রিপোর্ট তোলপাড় তুলেছে জনমানসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ‘২৫০ টাকার সুই ২৫ হাজার’। রিপোর্টে নিউরো হাসপাতালের একমাসের কেনাকাটার অস্বাভাবিক দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২৫০ টাকার সুই কেনা হয়েছে ১০০ গুণ বেশি দামে মানে ২৫ হাজার টাকায়। ৩/৪ শ টাকা দামের টিস্যু ফরসেপস কেনা হয়েছে ২০ হাজার টাকায়, ৬০ টাকা দামের ইউরিনারি ব্যাগ ১৩০০ টাকায়। আসলে আমার ধারণা খুঁজে দেখলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিটি কেনাকাটায় এমন অস্বাভাবিকতা পাওয়া যাবে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশের সব খাতেই কমবেশি দুর্নীতি হয়। কিন্তু মুখে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বলা হলেও বাস্তবে দুর্নীতি ঠেকানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না। নিউরোসায়েন্সের আলোচিত দুর্নীতিটি ২০১৮ সালের। এ বিষয়ে ২০১৯ সালে তদন্তও করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু কেউ শাস্তি পায়নি আজও। আসল সমস্যা এখানেই।
দুর্নীতির চেয়ে বড় সমস্যা হলো, দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের নির্বিকারত্ব। ২০১৮ সালে নিউরো হাসপাতালের যারা দুর্নীতি করলো, তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে পরবর্তীতে অন্য কেউ দুর্নীতি করার সাহস পেতো না। কিন্তু যখন জানবেন দুর্নীতি করলেও আপনার কিছু হবে না, তখন সুযোগ পেয়েও আপনি দুর্নীতি করবেন না কেন? নিজের ভেতরের নৈতিক বাধার কথা যদি বলেন, সেটা দুর্নীতিবাজরা ম্যানেজ করে ফেলে মসজিদ-মাদ্রাসায় টাকা দিয়ে।
মনের মধ্যে যেটুকু খচখচানি, সেটাও আর থাকে না। স্ত্রী-সন্তান, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাই দুর্নীতিবাজকে চেনে। কিন্তু কিছু বলে না। বরং অঢেল অর্থ আছে বলে, দুর্নীতিবাজরা একধরনের সমীহ পায়। মাঝে-মধ্যে দুয়েকজন আবজাল-মালেক ধরা পরে আমাদের একটু আলোচনার খোড়াক জোগায়।
Advertisement
করোনাকালে সবচেয়ে আলোচিত দুর্নীতিবাজ রিজেন্টের সাহেদ এবং জেকেজির সাবরিনা। এ দুজনই এখন কারাগারে আছেন। কিন্তু একটা বিষয় কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না, সাহেদ বা সাবরিনা কি নিজে নিজেই দুর্নীতি করেছে, নাকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেউ তাদের সাহায্য করেছে? টেবিলের দুই প্রান্তের মানুষের মধ্যে সমঝোতা থাকলে লেনদেন টেবিলের ওপর দিয়েই হতে পারে, পণ্যের মান বা প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক। টেবিলের অপর প্রান্তে যদি আবজালরা থাকে, তাহলে এই প্রান্তে তো সাহেদরা থাকতেই পারে। তবে টেবিলের এই প্রান্তের মানুষদের নিয়ে যত কথা হয়, ঐ প্রান্ত নিয়ে ততটা নয়।
দেশ রূপান্তরের একটি রিপোর্ট শুধু নয়; গত দেড়বছরের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি নিয়ে যত রিপোর্ট হয়েছে, তার কয়টি আমলে নিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রলণালয়? কয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে? সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মামলা করেছেন। ভালো কথা। কিন্তু রোজিনা গত একবছরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্টগুলো করলো, তার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিয়েছে? কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে? যদি রিপোর্টগুলো মিথ্যা হয়, তাহলে সেটা বলা হোক। আর সত্যি হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক।
টেবিলের ভেতরের দিতে কারা দুর্নীতিবাজদের সহায়তা করে, সেটা বের করা কিন্তু কঠিন নয়। কারা সাহেদের রিজেন্টকে অনুমতি দিল, কারা জেকেজিকে দুর্নীতি করার সুযোগ দিল, কারা ২৫০ টাকার সুই ২৫০০০ টাকায় কিনলো; এটা বের করতে মাসুদ রানা হওয়া লাগে না। শুধু ইচ্ছা থাকলেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তরের দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, ইচ্ছাটাই কারো মধ্যে নেই।
সাহেদ-সাবরিনা কাণ্ডের পর প্রবল সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তখনকার মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ পদত্যাগ করেছিলেন। কেন করেছিলেন? নিশ্চয়ই এই দুর্নীতিতে তার হাত ছিল। নইলে তো দৃঢ় অবস্থান নিতে পারতেন। যে দুর্নীতির দায়ে সাহেদ-সাবরিনা কারাগারে, সেই দুর্নীতিতে সহায়তার অভিযোগে কেউ কারাগারে গেল না কেন? একই দুর্নীতির এক প্রান্তের শাস্তি কারাগার, আরেক প্রান্তের শাস্তি পদত্যাগ, এটা হতে পারে না।
রোজিনার ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নয়, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে দেশ-জাতি উপকৃত হবে।’ এটাই আসল কথা। শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়, দেশ ও জাতির স্বার্থে সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এইচআর/জেআইএম