জাতীয়

নিয়ন্ত্রণে আসছে না চালের বাজার, কঠোর হচ্ছে সরকার

প্রত্যাশা ছিল বোরো ধান উঠলে চালের দাম কমবে। সাধারণ মানুষের অস্বস্তিও দূর হবে। বাস্তবে তেমনটি হয়নি। বোরোর ভরা মৌসুমেও চালের দামে প্রভাব পড়েনি। এখনও প্রতি কেজি মোটা চাল কিনতে আগের মতোই ৫০ টাকা গুনতে হচ্ছে ক্রেতাকে।

Advertisement

এ পরিস্থিতিতে ধান ও চাল নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা রোধে কঠোর হচ্ছে সরকার। এ সংক্রান্ত বিধিবিধানের কঠোর বাস্তবায়ন চায় খাদ্য মন্ত্রণালয়। অভিযান পরিচালনা করা দফতরগুলোকে খাদ্যশস্যের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রণালয়।

মজুত সংক্রান্ত বিধিবিধানের কঠোর বাস্তবায়ন, অভিযান পরিচালনা ও বাজার তদারকি কার্যক্রম জোরদারের জন্য খাদ্য অধিদফতর ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এবং সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি পাঠানো এ নির্দেশনার চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবকে।

Advertisement

গত বছরের শেষ দিকে চালের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। গরিবের মোটা চাল গিয়ে ঠেকে ৫০ টাকা কেজিতে। পরে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়। সরকারিভাবেও চাল আনার পদক্ষেপ নেয়া হয়। তবে কিছুতেই কিছু হয়নি।

পরে আশা জাগিয়ে রাখে বোরো। সে আশাও পূরণ হয়নি। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বোরো ধান উঠলেই কমবে চালের দাম। কিন্তু বোরো ঘরে উঠলেও দামে মেলেনি সুফল। শুরুতে কিছুটা কমলেও চালের দাম আবার বেড়ে সেই আগের জায়গায়ই ঠেকেছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের তথ্য নিয়ে শুক্রবার (২৮ মে) প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে চিকন (সরু), মাঝারি ও মোটা, সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহে চিকন চালের দাম ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৪ টাকা কেজিতে। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা চালের দাম ৬ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৬ ও মোটা স্বর্ণা ও চায়না ইরি চালের দাম এক সপ্তাহে ২ দশমিক ২০ শতাংশ বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা কেজিতে।

রাজধানীর বিভিন্ন বাজার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুচরা পর্যায়ে চালের দাম আরও বেশি।

Advertisement

খাদ্যশস্যের (চাল/ধান ও গম) বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে আগে বিভিন্ন সময়ে দেয়া নির্দেশনার ধারাবাহিকতায় নতুন করে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, ঢাকা মহানগরে খাদ্যশস্যের বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের আওতায় গঠিত মনিটরিং টিমের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে।

এতে আরও বলা হয়, মাঠ পর্যায়ে খাদ্যশস্যের অবৈধ মজুত নিয়ন্ত্রণ ও বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের দেশের সব জেলায় নিয়মিত অভিযান ও সংশ্লিষ্ট আইনের আওতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অব্যাহত রাখতে হবে।

কোনো মিলার যাতে অতিরিক্ত খাদ্যশস্য মজুত করে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে, সে বিবেচনায় খাদ্য মন্ত্রণালয়ের গত বছরের ২১ ডিসেম্বর এসআরও জারি করা হয় জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, এতে চালকল মালিক পর্যায়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টার ছাঁটাই-ক্ষমতা ধরে পাক্ষিক ছাঁটাই-ক্ষমতার তিন গুণ সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুতের বিধান রাখা হয়। এই এসআরওতে দেয়া নির্দেশনা মিলাররা যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে কি না- তা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে এবং নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আইন/বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

২০১১ সালের ৫ মে খাদ্যশস্যের মজুতের বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় আরেকটি এসআরও জারি করেছে উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, সেই এসআরও অনুযায়ী আমদানিকারক পর্যায়ে আমদানিকৃত পণ্যের (চাল/ধান এবং গম/গমজাত দ্রব্য) শতভাগ ৩০ দিন মেয়াদে সংরক্ষণ করা যায়। পাইকারি পর্যায়ে চাল/ধানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৩০০ মেট্রিক টন ৩০ দিন মেয়াদে সংরক্ষণ করতে পারবেন এবং গম/গমজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে মজুতের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২০০ টন ৩০ দিন মেয়াদে সংরক্ষণ করতে পারবেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা চাল/ধান সর্বোচ্চ ১৫ টন, ১৫ দিন এবং গম/গমজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে মজুতের সর্বোচ্চ পরিমাণ ১০ টন, ১৫ দিন মেয়াদে সংরক্ষণ করতে পারবেন। এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন তদারকি জোরদার করতে হবে।

‘ফুডগ্রেইন লাইসেন্স ছাড়া কেউ যাতে খাদ্যশস্যের ব্যবসা না করতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে এবং আমদানিকারক/আড়তদার/পাইকারি বিক্রেতার ধান/চাল বিক্রি সংক্রান্ত তথ্য সাপ্তাহিক ভিত্তিতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ে জমা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।’

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এসআরও’র নির্দেশনার আলোকে বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্যের মজুত সম্পর্কিত বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন নির্ধারিত ছকে প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে নিয়মিতভাবে খাদ্য অধিদফতর/খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নিশ্চিতের অনুরোধও জানানো হয় চিঠিতে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মনিটরিংটা চলমান প্রক্রিয়া। এজন্য আমরা নিয়মিত তাগিদ দিই। সেজন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘চালের দাম যেভাবে বেড়েছে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দাম আর সেভাবে কমবে না। গত বছর কৃষি মন্ত্রণালয় বলেছিল, জুন মাস পর্যন্ত চাহিদা পূরণ করে আরও উদ্বৃত্ত থাকবে। সেই কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, আম্ফান ও উপর্যুপরি বন্যায় আমাদের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটা পূরণ হয়নি। তবে এবার উৎপাদন বাড়বে।’

সচিব বলেন, ‘২০১৮ ও ২০১৯ সালে চালের অস্বাভাবিক দরপতন হয়েছিল। সেটা হয়েছিল ভারত থেকে ৫০ থেকে ৭০ লাখ টন চাল আমদানির কারণে। আমরা এবার ভারত থেকে ১৫ লাখ টন চাল আনতে চেয়ে এনেছি সাড়ে ৭ লাখ টন। যদি আবার ৭০ লাখ টন আনতে পারতাম তবে আগের দামে যেতে পারতাম। সেটা আমরা করিনি, কারণ কৃষককে মারার উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আমরা আর ওই পর্যায়ে যাব না, তাই চালের দামও আর ওই পর্যায়ে যাবে না।’

‘বিধিবিধানগুলো আমরা কিছুদিন পর পরই ডিসিদের মনে করিয়ে দিই, কারণ তাদের হাজার কাজের মধ্যে এটা একটা কাজ। অভিযানপরিচালনা করেন ডিসিরা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। আমাদের (খাদ্য বিভাগের) লোকেরা মনিটরিং করে, তাদের তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই।’

নাজমানারা খানুম আরও বলেন, ‘বিধিবিধানগুলো পালন হয়, তবে মাঝে মাঝে গাফিলতি হয়। এজন্য আমরা চিঠি দিয়ে মনে করিয়ে দিই। মনে করিয়ে দিলে তারা একটু নড়েচড়ে বসবেন, কাজটা ঠিক মতো হয়।’

আরএমএম/এমএইচআর/জিকেএস