আন্তর্জাতিক

এমজিএমের পেছনে অ্যামাজন সাড়ে ৮শ কোটি ডলার খরচের কারণ কী?

মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার বা এমজিএম হলিউডের অন্যতম ক্ল্যাসিক একটি স্টুডিও। টম অ্যান্ড জেরি, দ্য উইজার্ড অব অজ, জেমস বন্ডের মতো জনপ্রিয় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো যে তাদেরই। দু’দিন আগে ৮৪৫ কোটি ডলারে এমজিএম কিনে নিয়েছে বর্তমান বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী জেফ বেজোসের প্রতিষ্ঠান অ্যামাজন। গত শতাব্দীতে একের পর এক প্রযুক্তিগত জটিলতায় ঝিমিয়ে পড়া স্টুডিওটি এ ধরনের একটি টেক জায়ান্টের হাতে পড়ায় তাদের নিয়ে নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন অনেকে। অবশ্য এতে এমজিএমের ঐহিত্য বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্রের ইউসিএলএ স্কুল অব থিয়েটার, ফিল্ম অ্যান্ড টিভির চলচ্চিত্র বিষয়ক অধ্যাপক জোনাথন কান্টজ বলেন, এমজিএম সত্যিকারে হলিউডের গল্প। গত ১০০ বছরে স্টুডিওটি ফিল্ম ব্যবসার সব কয়টি চক্র পার করে এসেছে।

Advertisement

তিনি বলেন, অনেক দিক থেকে ক্ল্যাসিক হলিউড স্টুডিওর ধারণা মানেই এমজিএম। সেই ধারণাগুলো কার্যকর ব্যবসায়িক কৌশল না হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে রাখার চেষ্টা করেছে তারা।

এমজিএমের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসসহ দেখে নেয়া যাক স্টুডিওটির পেছনে অ্যামাজনের বিপুল অর্থ খরচের কারণ কী-

‘এক ঘরে অনেক তারা’সময়ের সঙ্গে হলিউডের পরিবর্তন হলেও এমজিএম প্রায় পুরো সময়টা জুড়েই একই থাকার চেষ্টা করেছে। প্রায় এক শতাব্দী আগে একত্রীকরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা।

Advertisement

১৯২৪ সালে থিয়েটার মোগল মার্কাস লোউ মেট্রো পিকচার্স, গোল্ডউইন পিকচার এবং লুইস বি. মেয়ার প্রোডাকশনকে একত্রিত করে মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার প্রতিষ্ঠা করেন।

স্টুডিওটিকে হলিউডের স্বর্ণযুগের উদাহরণ বলা যায়। আজকের আধুনিক হলিউড কেমন হবে তার বীজ রোপণ করা হয়েছিল ওই সময়ে এবং তাদের হাত ধরে এমন অনেকগুলো চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল যা সিনেমাকেই সংজ্ঞায়িত করতে সাহায্য করে: দ্য উইজার্ড অব অজ, সিংগিং ইন দ্য রেইন এবং বেন হুর, যা ১১টি একাডেমি পুরস্কার জিতেছিল। এমজিএম হয়ে উঠেছিল হলিউডের প্রথম দিনগুলোর অন্যতম সফল স্টুডিও।

চলচ্চিত্র সমালোচক ও ইতিহাসবিদ লিওনার্ড মাল্টিন বলেন, একসময় এমজিএম ছিল হলিউডের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ স্টুডিও। এর গৌরবকাল কয়েক দশক ধরে টিকে ছিল। বলা হতো, স্বর্গের চেয়েও বেশি তারা রয়েছে এমজিএমে।

টেলিভিশনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে হলিউডে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। কিন্তু সেই পরিবর্তনে এমজিএম’ই ‘সবচেয়ে অনিচ্ছুক’ ছিল বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক কান্টজ।

Advertisement

তিনি বলেন, এমজিএম হলিউডের পুরোনো ধারা ধরে রাখার চেষ্টা করে। বলতে পারেন, এটি ছিল হলিউডের ধ্রুপদী যুগে প্রথম এবং আধুনিক যুগে সর্বশেষ স্থানে।

কার্কোরিয়ান, টার্নার এবং ইউএবর্তমানকালের মতো ১৯৬০-এর দশকের শেষভাগেও অশান্ত হয়ে উঠেছিল হলিউড। টেলিভিশনের উত্থান এবং দর্শকদের রুচি পরিবর্তনে হলিউডের ব্যবসা বিঘ্নিত হয় এবং বক্স অফিসে ব্যাপক ধস নামে। সেই সময় অন্য স্টুডিওগুলোর মতো এমজিএম’ও এই ক্ষতির মুখে পড়ে।

১৯৬৯ সালে ধনকুবের কার্ক কার্কোরিয়ান এমজিএমের নিয়ন্ত্রণ নেন। তবে স্টুডিওর উন্নতিতে নজর না দিয়ে তিনি বরং এর ব্র্যান্ড ব্যবহার করে গ্র্যান্ড হোটেলের মতো ব্যবসা চালু করেন। সেসময় ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে এমজিএমের ঐতিহ্য।

স্টুডিওটিকে নিয়ে লেখা একটি বইয়ের লেখক এবং ইউডব্লিউ-ম্যাডিসনের প্রফেসর এমিরিটাস অধ্যাপক টিনো বালিও বলেন, ওটা ছিল ৩৫ বছর মেয়াদী একটি সময়ের সূচনা, যার মধ্যে এমজিএম’কে অন্তত তিনবার বেচাকেনা করেন কার্কোরিয়ান।

এ ব্যবসায়ী তখন জেমস অব্রে জুনিয়রকে এমজিএমের ইনচার্জের দায়িত্বে বসান, যিনি খরচ কমাতে কঠোর পদ্ধতি অনুসরণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই, সত্তরের দশকে এমজিএম তার আগের সত্ত্বার একটি খোলসে পরিণত হয়। তবে কোনোভাবে ১৯৮১ সালে প্রোডাকশন হাউস ইউনাইডেট আর্টিস্ট (ইউএ) কিনে নিয়ে কিছুটা শক্তি জোগাড় করে তারা। ইউএ সেসময় জেমস বন্ডের মতো হিট ব্র্যান্ডের জন্য সুপরিচিত ছিল। তবে যাই হোক, ফের নতুন চুক্তিতে যেতে খুব বেশি দেরি হয়নি এমজিএমের।

১৯৮৬ সালে সিএনএনের প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নার নতুন গঠিত এমজিএম/ইউএ এন্টারটেইনমেন্ট কিনে নেন। টার্নার তার ক্যাবল নেটওয়ার্কে স্টুডিওর লাইব্রেরিতে থাকা সিনেমাগুলো দেখাতে চাচ্ছিলেন। অ্যামাজনও বিশাল সেই লাইব্রেরির জন্যই এমজিএম’কে কিনেছে, তবে ক্যাবল নেটওয়ার্কের বদলে তারা এর অনুষ্ঠানগুলো অনলাইন প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজন প্রাইমে দেখাবে।

আবার আগের কথা ফিরে যাওয়া যাক। ইউএ’র সঙ্গে একীভূত হওয়ার পরের কয়েক বছর বেশ কয়েকটি হিট সিনেমা উপহার দেয় এমজিএম। তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্টুডিওটি কেনাবেচা চলতেই থাকে। ঘটনাক্রমে এমজিএমের কিছু অংশ কার্কোরিয়ানের কাছে ফিরিয়ে দেন টার্নার, তবে ১৯৮৬ সালের আগের পুরো ফিল্ম ক্যাটালগ রেখে দেন তিনি, যার মধ্যে ‘দ্য উইজার্ড অজ’-এর মতো কয়েকটি ক্লাসিক চলচ্চিত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

১৯৯৬ সালে পুরো স্টুডিওটি আবারো কিনে নেন কার্কোরিয়ান। এরপর অরিয়ন পিকচার্সের মতো বিভিন্ন স্টুডিওর ফিল্ম লাইব্রেরি জড়ো করে এমজিএম, যার ফলে এটি ‘বিশ্বের বৃহত্তম ফিল্ম ভল্ট’-এ পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন টিনো বালিও।

অ্যামাজানের পদার্পণ২০০৫ সালে শেষবারের মতো এমজিএম বেচেন কার্কোরিয়ান। এবার তার মালিক হয় সনি পিকচার্সের নেতৃত্বাধীন একদল বিনিয়োগকারী। বালিও জানান, সনি তাদের ব্লু-রে প্রযুক্তির উন্নয়নে এমজিএমের চার হাজার ফিল্মের লাইব্রেরি ব্যবহার করতে চাচ্ছিল।

তবে ২০১০ সালে দেউলিয়া হওয়ার ঘোষণা দেয় স্টুডিওটি এবং তারা সিনেমার চেয়ে ঘরোয়া বিনোদন এবং টিভি অনুষ্ঠানের দিকে মনোনিবেশ করে।

অবশ্য তখনো জেমস বন্ডের মতো ইতিহাসের অন্যতম সেরা মুভি ফ্র্যাঞ্চাইজির হাত ধরে কোনোভাবে টিকে থাকে এমজিএম। কান্টজের কথায়, ‘জেমস বন্ডই একমাত্র ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজি, যা বাকি ছিল। অন্য সব কিছুই কেনা হয়ে গেছিল।’

আর এমন সময়েই এগিয়ে যায় অ্যামাজন। বিনোদন জগতে নিজেদের অবস্থান শক্তপোক্ত করতে ক্রমাগত অর্থ খরচ করে চলেছে অ্যামাজন। এক্ষেত্রে এমজিএমের বিশাল ফিল্ম লাইব্রেরি নিশ্চিতভাবেই তাদের একধাপ এগিয়ে দেবে।

জেমস বন্ড ছাড়াও রকি, দ্য হবিট, ক্রিড, দ্য হ্যান্ডমেইডস টেল, রোবোকপ, লিগ্যালি ব্লন্ডের মতো ফ্র্যাঞ্চাইজি এবং এপিক্স টিভি নেটওয়ার্কেরও মালিকানা রয়েছে এমজিএমের।

সূত্র: সিএনএন

কেএএ/এমএস