দেশজুড়ে

খুলনায় নতুন এলাকা প্লাবিত : পানিবন্দি মানুষের মানবেতর জীবন

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে খুলনার কয়রা উপজেলার চারটি ইউনিয়নে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে সাত থেকে আট ফুট ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। জোয়ারের চাপে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ২০টি জায়গায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে। ফলে প্রতিনিয়ত পানি ঢুকে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (২৭ মে) সকালে জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রামে ঢুকে পড়ে পানি। আগেরদিন জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয় উপজেলার অন্তত ৪০টি গ্রাম। ওইদিন বিকেলে স্থানীয়রা উদ্যোগ নিয়ে কয়েকটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ মেরামত করেছিলেন। কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে জোয়ারে বেড়িবাঁধসহ আরও কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়।

ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে দুর্গত এলাকার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। দুর্গত এলাকার অধিকাংশ কাঁচা বাড়িঘর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানির তোড়ে বিভিন্ন এলাকায় গ্রামীণ সড়কগুলো ভেঙে ব্যাহত হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। অনেক গ্রামেই ভেলা ও নৌকায় চলাচল করতে হচ্ছে। পানিবন্দি অধিকাংশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন কাছাকাছি উঁচু জায়গায় ও আশ্রয়কেন্দ্রে। তবে পানিবন্দি এসব মানুষ দুর্ভোগ-সঙ্কটে একরকম মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

দুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে বলে জানানো হলেও এখনও ত্রাণ পাননি বলে বানভাসি অনেকের অভিযোগ।

Advertisement

এছাড়া, বানের পানিতে ভেসে গেছে উপজেলার প্রায় দুই সহস্রাধিক পুকুর-জলাশয়ের মাছ। উপজেলা মৎস্য অফিস জানিয়েছে, উপজেলার মৎস্যজীবীরা প্রায় ১০ কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন।

বন্যার পানিতে বাড়ি ছেড়ে স্থানীয় বড়বাড়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা স্বামীহারা রোকেয়া বলেন, ‘আমাগের ঘর পানিতে ডুবি গেছে। বন্যার পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছি। কোনো অফিসার, চেয়ারম্যান মেম্বরেরা সাহায্য দিতে আসেনি। দুইদিন খেয়ে-না খেয়ে খুব কষ্টে আছি।’

পবনা এলাকার গৃহবধূ জায়েদা বলেন, ‘হুনছি, বইন্না এহনো আয় নায়। হেইতেই এত পানি। জানি না বইন্নায় কী অইবে!’

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আব্দুস সবুর গাজি বলেন, ‘আমরা দিন আনি দিন খাই। এখন পানিবন্দি কাজ নাই, খাবার নাই। খুব দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছি।’

Advertisement

দুর্গতরা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কোনো সহায়তা পাওয়া যায়নি। যখন জোয়ারের পানি বাড়ছে তখন অন্যত্র আশ্রয় নিতে হচ্ছে তাদের। তাদের দাবি এমন দুর্যোগে খাদ্য সহায়তা নয় টেকসই বেড়িবাঁধই বেশি প্রয়োজন।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজে ধীরগতি ও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় এলাকাবাসী দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছেন।

উপজেলার সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে মহারাজপুর ইউনিয়ন। সেখানকার চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল মামুন লাভলু জানান, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এর হোগলার দুইটি, দশালিয়ার দুইটি, মঠবাড়ির দুইটি পয়েন্ট, মোট ৬ টি পয়েন্ট ভেঙে হোগলা, দশালিয়া, মঠবাড়ী, আটরা, গোবিন্দপুর, জয়পুর, শিমলারাইট, বাউলিয়া ঘাটা, মঠের ডাঙ্গা, সুতির কোনা, সুতির ধার, পোলাডাঙ্গার চক, মোড়লের চক, অন্তাবুনিয়া, দেয়াড়াসহ অন্তত ২১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়েছে সহস্রাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে শত শত একর জমির মৎস্য ঘের।

আগামী ২৮ মে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ভেঙে যাওয়া জায়গাগুলো আটকানোর চেষ্টা করবেন বলে চেয়ারমান জানান।

উত্তর বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান সর্দার নুরুল ইসলাম জানান, গাতিরঘেরী থেকে বীণাপাণি পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার বেড়িবাঁধের চারটি ও পদ্মপুকুর এলাকার একটি জায়গা দিয়ে লাগাতার পানি প্রবেশ করে হরিহরপুর পদ্মপুকুর গাতির ঘেরী বীণাপাণিসহ অন্তত সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। এরমধ্যে কিছু মানুষ হরিহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পদ্মপুকুর কপোতাক্ষ স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে।

দক্ষিণ বেদকাশী ইউপি চেয়ারম্যান কবি শামসুর রহমান জানান, আংটিহারা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার ভেঙে লাগাতার জোয়ারের পানি প্রবেশ করায় আংটিহারা, ঘড়িলাল, জোড়শিং, পাতাখালি, গোলখালীসহ ৫-৭ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

এ বিষয়ে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের আগেই কয়রায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এরপর ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের কারণে কয়রায় কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে সাত থেকে আট ফুট বেশি উচ্চতার জোয়ার প্রবাহিত হচ্ছে। এতে বাঁধের ৬টি পয়েন্ট ভেঙে ও ৩০টি পয়েন্ট থেকে পানি উপচে উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়েছে। লোকালয়ে পানি ঢুকে অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের কাজ চলমান আছে। ভালোভাবে সংস্কার করতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের জন্য অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। এ বাঁধ আমরা অচিরেই সংস্কার করব।’

উপজেলা নির্বাহী অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জোয়ারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে ইতোমধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। এছাড়া দুর্গত এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা মজুত আছে। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ৪টি ইউনিয়নে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে ইউনিয়ন প্রতি আড়াই টন চাল ও নগদ ২৫ হাজার করে টাকা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে বণ্টন করা হয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং পরিবারের তালিকা প্রস্তুতের কাজও শুরু করেছি।পর্যায়ক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বানভাসি অসহায় সব মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দেয়া হবে।’

এসএস/জেআইএম