মতামত

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, না খোলার বিতর্ক

গত ২৪ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছেন। স্লোগান তুলেছেন, ‘ছাত্রসমাজকে বাঁচান’, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন’, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন, নয় তো গলায় দড়ি দিন’।

Advertisement

অবশেষে মনে হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঘুম ভেঙেছে। তারা সদয় হয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে। শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ২৬ মে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১২ জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে পরদিন ১৩ জুন থেকে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ১৩ জুন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়টি নির্ভর করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আবাসিক হলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের টিকা দেওয়ার ওপর।

প্রায় ১৫ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পর এটি অনেকের কাছে একটি স্বস্তিদায়ক ঘোষণা ছিল। একই সঙ্গে আবার বিতর্কও তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীদের টিকা না দিয়ে এই খোলার সিদ্ধান্ত কতটা বুদ্ধিমানের সেই প্রশ্ন আসছে। আবার স্কুল আগে খোলার সিদ্ধান্তকে অনেকে বলছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তুঘলকি সিদ্ধান্ত। স্কুল নয়, আগে খোলার দরকার তো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। উল্টো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কি! সরকারবিরোধীরা কেউ কেউ ভাবছেন সরকার ছাত্র আন্দোলনের ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে বেশি গড়িমসি করেছে। কারণ এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হল খোলা ও পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েও পিছু হটেছে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় খোলার বিষয়টি হয়তো টিকার ওপর খানিকটা নির্ভর করছে। শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কাছে চাওয়া হয়েছে। যেহেতু শিক্ষার্থীদের বয়স ৪০-এর নিচে, তাই অধিকাংশই হয়তো টিকা নিতে পারেননি। টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিকল্প কী করা যায়, সেটা ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নিতে পারবে।

Advertisement

অনলাইন শিক্ষা নিয়েও কথা উঠেছে জোরেশোরে। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে শিক্ষা নিয়ে যতটা অসুবিধায় আছে, তাদের চেয়ে বেশি অসুবিধায় শিক্ষকরা। তারা অনলাইন শিক্ষার মডেল তৈরি করেছেন কিনা- প্রশ্ন আসছে। কারণ ট্রেডিশনাল নিয়মের শিক্ষা যেমন অনলাইনে দেওয়া কঠিন তার চেয়ে বেশি কঠিন শিক্ষা পরবর্তী মূল্যায়ন বা পরীক্ষা নেওয়া। তার জন্য বর্তমান শিক্ষা কাঠামোর বাইরে শিক্ষা পদ্ধতির দরকার আছে, শিক্ষকদের মেধার দরকার আছে। মডেলটি ঠিক আছে কিনা পরীক্ষার দরকার আছে। কারণ সময়ের প্রয়োজনে এই অনলাইন মডেল আরও দীর্ঘস্থায়ী করতে হতে পারে।

এ ধরনের মডেল ছিল না বলেন গত বছর এইচএসসি পরীক্ষা ছাড়াই অটোপাস দেওয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এবার পরীক্ষা ছাড়াই এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাস দেওয়ার সুযোগ কম। দেওয়া ঠিকও হবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত হচ্ছে এ বছর সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী বছরের (২০২২) এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও হবে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে। এ জন্য এসএসসি পরীক্ষার জন্য ১৫০ দিন এবং এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ১৮০ দিন ক্লাস করানোর জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি করা হয়েছে। এ ছাড়া এসব শিক্ষার্থীর জন্য আগামী জুন থেকে সপ্তাহে দুটি করে অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হবে।অন্যদিকে এ বছরের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হলো, যদি পরীক্ষা নেওয়ার মতো পরিস্থিতি হয় তাহলে পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। অন্যথায় অ্যাসাইনমেন্টের ভিত্তিতে এই পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে।

এটাতো গেল স্কুল প্রসঙ্গ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তো বিচিত্র। সাধারণ শিক্ষা, সেখানে আবার ইংরেজি-বাংলা ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা। আবার মাদরাসায় আলিয়া মাদরাসা ও কওমি- দুই ধারার শিক্ষা। করোনাকালে শিক্ষার বৈষম্য নানাভাবে বেড়েছে। একই পদ্ধতির শিক্ষায় গ্রাম ও শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য বেড়েছে। কোথাও অনলাইনে ক্লাস হয়েছে, কোথাও সেই সুযোগ নেই। বেসরকারি-সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও ব্যবধান আরও বেড়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পরীক্ষা-ক্লাস হচ্ছে। প্রতি সেমিস্টারে শিক্ষার্থীও ভর্তি করা হচ্ছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃত অর্থে শিক্ষা কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে আছে।

Advertisement

আমার ধারণা গ্রামের স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম করোনাকালে সবচেয়ে মারাত্মক অবনতি হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল স্থানীয় ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত প্রশাসন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ছেড়ে দেওয়া। পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া। কিন্তু সরকার সবকিছু কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকানো যায়নি। তাহলে ঢালাওভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে কী লাভ হলো! সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় প্রশাসনের ওপর ছেড়ে খুলে দিলে পরবর্তীকালে সংক্রমণ বাড়লে আবার বন্ধও করতে পারত। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সহজ। শিক্ষার্থীদেরও ভাগ করে ক্লাসে আনা যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামসহ যেসব অঞ্চলে করোনার সংক্রমণ কম, সেসব এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আগে খোলা যেত। সরকার এর আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার একটা সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করেছিল। অনেক স্কুল প্রস্তুতিও নিয়েছিল। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলো এতে বেশি আগ্রহী হয়ে শিক্ষার্থীদের সামাজিক দূরত্ব মেনে বসার ব্যবস্থাও করেছিল। তাদের শিক্ষার্থী কম বলে এটা অসম্ভব ছিল না। কারণ হিসেবে আমাকে একটি স্কুলের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে অন্তত তারা ফাইনাল পরীক্ষাটা স্কুলে নিতে চেয়েছেন। জুনের মধ্যে সেই পরীক্ষা শেষ করার কথা, যা এখন তারা অনলাইনে নিয়ে নিজেরাও সন্তুষ্ট নন। অভিভাবকরাও অসন্তুষ্ট। এর আগের বছরের ফাইনালও অনলাইনে নিয়েছিলেন তারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না খোলা নিয়ে নানা বয়ান দিয়েছেন এতো দিন। একবার বলছেন, খোলা হবে। আরেকবার বলছেন, বন্ধ থাকবে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশেই করোনার মধ্যে সীমিত পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। যদিও ওই সব দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। যেখানে অন্যান্য দেশ টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিয়েছে, সেখানে আমরা তাদের কথা চিন্তা করিনি অথচ রোল নাম্বার ধরে স্কুলে এই কার্যক্রম শেষ করা যেত। এখন তো টিকাই নেই। খোলা না খোলা নিয়ে তো আরেক অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।

রাজধানীর একটি বড় বালিকা বিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক আমাকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, সরকার স্কুল খুলে দিলেও টিকা ছাড়া তিনি তার মেয়েকে স্কুলে যেতে দেবেন না। ফলে ঢাকা শহরে স্কুল খুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কতটা নিশ্চিত করা যাবে- এটা নিয়ে আমি সন্দিহান। কারণ ঢাকায়ই করোনা সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি, যদিও সরকার বলছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে তারা তিন ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে।

একটি হচ্ছে—শিক্ষক-কর্মচারীদের টিকা নেওয়া, দ্বিতীয়টি হচ্ছে—শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিস্কার ও স্বাস্থ্যসম্মত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা এবং তৃতীয়টা হচ্ছে—শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে নজর দেওয়া। এতো কিছুর পরও এখন সবার আগে আসছে টিকার প্রশ্ন। টিকাই যদি না আসে সরকারের এসব পরিকল্পনা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অতি বিলম্বিত সিদ্ধান্ত কতটা কাজ দেয় এখন দেখার বিষয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com

এইচআর/এমকেএইচ