ঝালকাঠি সদর উপজেলার বুক চিরে বয়ে গেছে সুগন্ধা নদী। নদীর উত্তর পাড়ে শহর ও দক্ষিণ পাড়ে পোনাবালিয়া ইউনিয়ন। ওই ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রাম থেকে নদী পার হয়ে শহরে দুধ বিক্রি করেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মিলন সিকদার। তিনি কাঞ্চন সিকদারের ছেলে। মিলন বলেন, জন্মের পর থেকেই চোখে কম দেখি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের ধারণক্ষমতাও কমতে থাকে। স্থানীয় আফসার মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় দু’চোখের অবস্থা আরও করুণ হওয়ায় পড়াশোনায় সামনে এগানো হয়নি।
Advertisement
তিনি বলেন, পারিবারিক খরচে বরিশাল গ্রামীণ জিসি চক্ষু হাসপাতাল এবং ঢাকায় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চোখের চিকিৎসা করানোর পরও চোখের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। দু’চোখ পুরোপুরি অন্ধ না হলেও মারাত্মক ধরনের ঝাপসা দেখা যায়। ধোঁয়া ধোঁয়া অবস্থায় দেখতে পাওয়ায় কিছুটা চলাফেরা করতে পারি।
‘তার মধ্যে অনেক সময় হঠাৎ করে অন্ধকার হয়ে যায়। তখন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে আবার ঝাপসা বা ধোঁয়া ধোঁয়া দেখা যায়। তার মধ্যেই পথ চলতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজে দুটি গাভি পালন করি এবং প্রতিবেশীদের পালিত গাভির দুধ সংগ্রহ করে শহরে বিক্রি করি। আমি দুধে কোনো ভেজাল (পানি) দেই না এবং কাউকে মাপেও কখনো কম দেই না। একটি সিলভারের গ্লাসে ধারণা (অনুমান) করে মেপে দেই। আমি চোখে দেখতে না পেলেও যারা আমার কাছ থেকে দুধ কেনে তারা তো দেখেন।
Advertisement
‘প্রতি লিটার দুধ ৭০ টাকায় বিক্রি করি। ডুপ্লিকেট বা দুই নম্বরি (ভেজাল) দিলে ক্রেতারা আমার চেয়ে ভালো দেখতো। তাহলে আমি আর দুধ বিক্রি করতে পারতাম না। আমার যতই কষ্ট এবং লোকসান হোক, দুধে ভেজাল আর মাপে কম দেব না। নদী পারাপারে সমস্যা হলে মাঝিরা সবাই আমাকে চেনে, তারাই আমাকে পারাপারে সহায়তা করেন।’
ব্যক্তি জীবনে মিলন ৭ বছর বয়সী এক কন্যাসন্তানের জনক। মিলনের মতোই তার কন্যারও এক চোখের দৃষ্টিতে সমস্যা রয়েছে। বাবার রোগেই আক্রান্ত হচ্ছে সে। তবে মেয়েটি জন্মগত না হলেও চার বছর বয়স থেকে এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে। দুধ বিক্রি করে যা উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়।
‘তার পরও যা পাচ্ছি তা দিয়ে কোনোমতে সংসার চলছে। কিন্তু মেয়ের চোখ নিয়ে অনেক চিন্তায় আছি। মেয়ে মানুষ, দিন যাবে বড় হবে। একটা সময় বিবাহ উপযুক্ত হলে বিয়ে দিতে হবে। কীভাবে তার চিকিৎসা করাব, নাকি আমার মতোই চিরজীবন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী থাকবে।’
ঝালকাঠি শহরের বান্দাঘাট এলাকার দুধ ক্রেতা আমিরন বিবি জানান, মিলনের কাছ থেকে আমরা কয়েক বছর ধরেই দুধ কিনি। ওর দেয়া গরুর দুধ অনেক ভালো। আগুনে জ্বাল দিলে পুরো সর পড়ে। রাজাপুরের বাদুরতলা নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আক্তারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, মিলনের কাছ থেকেই ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দুধ রাখি, অন্য কারও কাছ থেকে দুধ রাখি না। যদি কোনো কারণে মিলন আসতে না পারে, তাতে যদি পাঁচ দিনও হয় তার পরও অন্য কোথাও থেকে দুধ নেই না। মিলনের দেয়া গরুর দুধ কোনো পানি মেশায় না, খাঁটি দুধ পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, মিলন অন্ধ মানুষ। অনেক কষ্ট করে দুধ নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসে। তাই তার কাছেই দুধ রাখা হয়। যাতে আমাদের দুধের চাহিদা পূরণ হয়, অপরদিকে মিলনেরও আর্থিক সহায়তা হয়।
Advertisement
মো. আতিকুর রহমান/এমআরএম/এএসএম