ভ্রমণ

ঘুরে এলাম ড্রামের তৈরি বিস্ময়কর ভাসমান সেতুতে

মো: বিল্লাল হোসেন

Advertisement

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। ছোট্ট এ দেশটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রান্তিক জনপদের হওয়ায়; তাদের বসবাসও গ্রামীণ জনপদে। আর গ্রামীণ জনপদে মিশে আছে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আদিকাল থেকেই ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি আবেদনময়ী। আর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেখা মেলে বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে গঞ্জে কিংবা বন বাদাড়ে।

বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে অজস্র নদী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গতিপথ পাল্টেছে এবং প্রতিটি নদীর নাম পরিবর্তিত হয়েছে জায়গাভেদে। তেমনি একটি নদী হলো মধুমতি নদী। এ নদীর অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা আছে। তার মধ্যে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলায় অবস্থিত মধুমতি নদীর বাওড়।

মূলত আলফাডাঙ্গা উপজেলার টগরবন্দ ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে এই বাওড়টি। এই বাওড়টি এখানকার মানুষের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের প্রত্যক্ষ সঙ্গী। টগরবন্দ ইউনিয়নের মানুষ ঘুম থেকে উঠেই যেন এই বাওড়টির কলকল বয়ে চলার ধ্বনি শুনতে পায়। এটি যেমন এখানকার মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম অবলম্বন; তেমনই অনেক দুঃস্বপ্নের সাক্ষী এই বাওড়টি।

Advertisement

টগরবন্দ ইউনিয়নের টিটা, টিটা-পানাইল, রায়ের পানাইল, শিকারপুর, ইকড়াইল ও কুমুরতিয়া গ্রামের প্রায় ১২ হাজার মানুষের চলাচল এই বাওড়টির উপর দিয়ে। এতদিন এই মানুষগুলো উপজেলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল নৌকা পারাপার। অনেক সময় বৈরি আবহাওয়ায় বন্ধ হয়ে যেত নৌকা। ফলে এলাকাবাসী পড়ত চরম দুর্ভোগে।

সেই দুর্ভোগ লাঘবের উদ্দেশ্যেই এই বাওড়টির উপরে নির্মিত হয়েছে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম ভাসমান সেতু। যা এলাকাবাসীর কাছে টিটা ভাসমান সেতু নামে পরিচিত। ভাসমান সেতুটি নির্মিত হয়েছে সম্পূর্ণ এলাকার মানুষের অর্থায়নে। সেতুটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকার মতো।

সেতুটির মূল কাঠামোতে ৮৫২টি প্লাস্টিকের ড্রাম ও ৬০ টন লোহার ফ্রেম ব্যবহার করা হয়েছে। মূলত ড্রাম ব্যবহারের ফলে সেতুটি সবসময়ই ভেসে থাকে। আর এজন্যই সেতুটি নামকরণ করা হয়েছে ভাসমান সেতু। সেতুটি দৈর্ঘ্যে ৮০০ মিটার লম্বা ও প্রস্থে ১২ ফুট চওড়া। সেতুটির উপর দিয়ে সহজেই ভ্যান, মোটর সাইকেলসহ ছোট যানবাহন খুব সহজে চলাচল করতে পারে।

সেতুটি ২০২০ সালের ২৮ মার্চ উদ্বোধন করা হয়। এই সেতুটি উদ্বোধন করার ফলে এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এখানকার মানুষ নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় কাজ করতে সেতু দিয়ে যাতায়াত করছেন নিয়মিত। তাদের সেই চরম কষ্টের দিনগুলো এখন সমাপ্ত হয়েছে। উদ্বোধনের পর থেকে সেতুটি দারুণভাবে পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে।

Advertisement

যেহেতু আমার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়, তাই আমিও এই সেতুর ছবি এবং ভিডিও দেখে দারুণভাবে আকৃষ্ট হই। গত ১৯ মে ২০২১ তারিখে আলফাডাঙ্গা থেকে বাইকে রওনা হই ভাসমান সেতুটি দেখার উদ্দেশ্যে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য টিটা ভাসমান সেতুতে।

প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যাই সেতুটির। বাওড়ের দুই তীরে শুধু সবুজের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ প্রকৃতি যেন সবুজ গালিচা সাজিয়ে রেখেছে; যা দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। আর বাওড়ের পানির রং দেখলেই কেমন মায়া লাগে। কি অসাধারণ দৃশ্য! মুহূর্তেই প্রাণ জুড়িয়ে যায় এমন দৃশ্য দেখলে।

সেতুটি নতুন তাই এখনো সেভাবে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। এজন্য যে প্রাকৃতিক পরিবেশ পূর্বে ছিল সেটি এখনো বিরাজমান। আর আমার মনে হয় প্রাকৃতিক পরিবেশই এই ভাসমান সেতুকে অসামান্য রূপ দান করেছে। নদীর পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট খাবারের দোকান কিংবা রেস্তোরাঁ। এ ছাড়াও আছে গাড়ি পার্কিং ও বসার জায়গা।

ভাসমান সেতুর পাশেই পানির মধ্যে তৈরি করা হয়েছে ভাসমান রেস্তোরাঁ। যা এই ভাসমান সেতুকে আরো বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে। এই রেস্তোরায় বসে খেতে খেতে বা গল্প করতে করতে আপনি শুনতে পাবেন মধুমতি নদীর পানির ছলছল বয়ে চলার শব্দ। নিমিষেই হারিয়ে যাবেন সোনালি শৈশবে। ইচ্ছে করবে এখনই ঝাঁপ দেই বাওড়ের পানিতে আর আর মেতে উঠি দুরন্তপনায়। এ ছাড়াও এখানে আছে ভ্রাম্যমাণ ঝালমুড়ি, ফুচকা ও চটপটির দোকান।

আপনি চাইলে গোসল করতে পারবেন টিকিট কাউন্টারে থাকা তোয়ালে সংগ্রহ করে নিয়ে। ভাসমান সেতুর উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপনার মনে হবে নদীর বয়ে চলার সঙ্গে আপনিও যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছেন। আর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আপনি নদীকে অনুভব করতে পারবেন খুব সহজেই। এই সেতুর গঠনশৈলী আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবে দারুণ এক স্থাপনার সঙ্গে, যা আপনি আগে কখনো দেখেননি।

মনোমুগ্ধকর ও নিরিবিলি পরিবেশ ভাসমান সেতুটির অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। তাই আপনার যদি মন খারাপ থাকে, তাহলে এ সেতুতে গেলে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি অবশ্যই আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। এখানের প্রতিটি বালুকণাই যেন সৌন্দর্য্যে ভরপুর। মোট কথা, আপনি যদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বিলাসী হন তাহলে ভাসমান সেতুটি আপনাকে অবশ্যই বিমোহিত করবে এর সুনিপুণ সৌন্দর্য দিয়ে।

ভাসমান সেতুটি একেবারে নতুন হওয়ায় সেভাবে পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। তবে একে যদি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হয় তাহলে ফরিদপুর জেলার তথা বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠবে এই ভাসমান সেতুটি।

বাওড়ের দুই পাশে মানসম্মত খাবার রেস্তোরা, হোটেল-মোটেল এবং গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা করা গেলে সেতুটি হয়ে উঠবে দারুন একটি পর্যটন কেন্দ্র। ফলে দুই পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটবে সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি পাবে।

বিপুল পরিমাণ পর্যটক এখানে আসলে অর্থনীতিতে যোগ হবে প্রচুর পরিমাণে অর্থ। যা দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত কল্যাণকর। তাই সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রটি হয়ে উঠুক বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম অংশীদার এ প্রত্যাশা সব সময়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।

জেএমএস/এমকেএইচ