দেশজুড়ে

ইয়াস : খুলনায় খোলা হয়েছে সহস্রাধিক আশ্রয়কেন্দ্র

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ইয়াস অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বুধবার (২৬ মে) দুপুরে উত্তর ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ উপকূল অতিক্রম করতে পারে। এ অবস্থায় ইয়াস নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে খুলনার উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তাদের দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ দুর্বল বেড়িবাঁধ।

Advertisement

সিডর, আইলা, বুলবুল, আম্ফানের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলের মানুষ। এখন নতুন করে এসেছে ইয়াস। ইয়াসের প্রভাবে খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছার বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ উপচে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে।

এছাড়া মঙ্গলবার (২৫ মে) দিনব্যাপী চলে রোদ-মেঘের লুকোচুরি খেলা। থেমে থেমে হালকা ও মাঝারি বৃষ্টি হয়েছে। খুলে রাখা হয়েছে সহস্রাধিক আশ্রয়কেন্দ্র।

এদিকে সিপিপি, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলয়া এবং নিরাপত্তায় কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও।

Advertisement

খুলনার আঞ্চলিক আবহাওয়া কার্যালয়ের সিনিয়র আবহাওয়াবিদ আমিরুল আজাদ বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস সর্বশেষ বুলেটিন অনুসারে মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৩২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। দুদিনে খুলনায় ২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ৯ মিলিমিটার এবং সোমবার ১২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।’

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আজিজুল হক জোয়াদ্দার বলেন, ‘খুলনার ৯ উপজেলার ১ হাজার ৪৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যমান ৩২৪টি। এ ছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসা মিলিয়ে আরও ৭২৪টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এখানে ধারণক্ষমতা প্রায় চার লাখ। প্রস্তুত রয়েছে ১১৬টি মেডিকেল টিম। নির্দেশনা পাওয়ামাত্র স্থানীয়দের আশ্রয়কেন্দ্রে আনা হবে।’

খুলনার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ হলো কয়রা। উপজেলায় ১৫৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে, যার প্রায় অর্ধেক ঝুঁকিপূর্ণ।

Advertisement

পাউবো সাতক্ষীরা বিভাগ-২ এর পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশিদুর রহমান বলেন, ‘কয়রা উপজেলার ২৪টি স্থানের বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। ইয়াসের প্রভাব থেকে কয়রাবাসীকে বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে সেই স্থানগুলোতে কাজ করা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার সকালে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় ৪ থেকে ৫ ফুট বেড়ে যায়। জোয়ারের পানি এমন থাকলে খুব বেশি সমস্যা হবে না। তবে যদি পানির উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুট হয়, ও বাতাসের তীব্রতা বাড়ে, তাহলে বাঁধ টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।’

খুলনার কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, জোয়ারের পানি বেড়েছে। দু-একটি স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করেছে। এসব স্থানে চেয়ারম্যান, স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় জনগণ বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন। উপজেলায় ১১৮টি আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঝুঁকিপূর্ণ। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার মানুষের ব্যবস্থা রয়েছে।

পাইকগাছা ইউএনও এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী বলেন, সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। উপজেলার ১০৮টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৫৯ হাজার মানুষ থাকতে পারবে। ৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের জন্য শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ৩০ হাজার বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট রাখা হয়েছে। চিকিৎসাসেবায় ১১টি মেডিকেল টিম রয়েছে। একটি অ্যাম্বুলেন্স, পাঁচটি মাইক্রোবাস প্রস্তুত রয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে দুইটি নসিমন প্রস্তুত রাখা হয়েছে অতি জরুরি উদ্ধারকাজের জন্য। ঘূর্ণিঝড় বিষয়ে সচেতনতার জন্য মাইকিং করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলার গড়ইখালী উত্তর পুংখালী এবং দেলুটির একটি বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সেখানে বালুর বস্তা ফেলা হয়েছে। সোলাদানা ইউনিয়নের একটি আশ্রয়ণ প্রকল্পের অবস্থা নাজুক। অতি জোয়ারে কী অবস্থা হবে বোঝা যাচ্ছে না। প্রচণ্ড জোয়ারের চাপ। দুশ্চিন্তার অন্যতম কারণ জোয়ারের পানি উপচে পড়া।’

দাকোপ ইউএনও মিন্টু বিশ্বাস বলেন, ‘উপজেলায় ১২৩টি আশ্রয়কেন্দ্র ৮০ হাজারের বেশি মানুষ থাকতে পারবে। এরইমধ্যে খাবারের ব্যবস্থাসহ সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।’

খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুব হাসান বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলয়া জেলার প্রতিটি ওয়ার্ডে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সাথে মতবিনিময় করা হয়েছে। পুলিশ সদস্যদের কোন ছুটি নেই। কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা থানা এলাকায় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্য কাজ করছেন। প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপত্তায় পুলিশ সদস্যরা কাজ করবেন। মানুষের নিরাপত্তাকে মাথায় রেখে সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।’

খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন বলেন, ‘সাইক্লোন শেল্টারসহ সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে উপকূলীয় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটা উপজেলাকে। বেড়িবাঁধকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। মেডিকেল টিম, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পর্যাপ্ত শুকনা খাবার প্রস্তুত রাখা হয়েছে।’

এ ছাড়া প্রস্তুত রয়েছে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে ফায়ার সার্ভিস, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও কোস্টগার্ড, জানান জেলা প্রশাসক।

আলমগীর হান্নান/এসজে/জেআইএম