“আমি চিরতরে দূরে চলে যাবতবু আমারে দেবনা ভুলিতে,আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশবেনী যাবে যবে খুলিতে।... ... ... ... ... ...তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।”
Advertisement
১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে রেকর্ডিং চলাকালীন অবস্থায় হঠাৎই কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার জিভ আড়ষ্ট হয়ে জড়িয়ে গেল। থরথর করে কাঁপছিল তার ঠোঁট। মুখ দিয়ে কোনো স্বর বের হচ্ছিল না। অনেকেই জানেন, আবার অনেকেই জানেন না কবি নজরুল কী রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ নিয়ে বিভ্রান্তিও কম ছড়ানো হয়নি। যে রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত কাটিয়েছেন, সেই রোগের নাম কী? যে রোগে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘ সময় নির্বাক ও জীবন্মৃত অবস্থায় কাটিয়েছেন, সেই রোগের নাম ‘পিকস ডিজিস’। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুন কলকাতার নাগরিকদের উদ্যোগে নতুন করে যে ‘নজরুল নিরাময় সমিতি’ পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশ-এ গড়ে উঠেছিল, তাদের পক্ষ থেকে বিকলমেধা কবি-দেহটিকে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাছে হাজির করানোর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী, তার পরামর্শও একাধিকবার পাওয়া গেল যদিও পীড়ার প্রথম পর্বে বিধানচন্দ্রের মতো চিকিৎসককে দিয়ে নজরুলকে ভালোভাবে পরীক্ষা করানো বোধহয় সম্ভবপর হয়নি।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই সেই রাঁচিতেই নজরুলকে সরকারিভাবে পাঠানো হয়; কিন্তু ১০ বছর আগে পাঠালে তখন হয়তো কোনো সুফল পাওয়া যেত। রাঁচিতে মেন্টাল হাসপাতালের অধ্যক্ষ মেজর ডেভিস চার মাস পরীক্ষা ও চিকিৎসা করেও নজরুলের অবস্থার কোনো উন্নতি সাধন করতে পারেননি, রোগ নির্ণয়েও কোনো আলোকপাত করেননি। নিরাময় সমিতির সদস্যরা সরকারের অর্থসাহায্যে এই প্রথম প্রায়-নির্বিকার কবিকে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। নজরুলের সঙ্গে গেলেন পঙ্গু রোগিণী প্রমীলা, পুত্র অনিরুদ্ধ এবং নিরাময় সমিতির পক্ষে জনৈক রবিউদ্দীন আহমদ। ১০ মে ১৯৫৩ সালে জাহাজযোগে যাত্রা করে তারা লন্ডনে পৌঁছলেন চার সপ্তাহ পরে। লন্ডনে চিকিৎসকদের যে বোর্ড নানাভাবে কবি নজরুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগ উপশমের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাদের কারও পক্ষেই রোগীর অবস্থা উন্নয়নের কোনো পন্থা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। উক্ত রবিউদ্দিন আহমদ কর্তৃক সংরক্ষিত, লন্ডনের চিকিৎসকদের স্বাক্ষরযুক্ত মেডিকেল রিপোর্টটি পরবর্তীতে প্রচারিত হয়েছে। রবিউদ্দিন আহমদের পরিবার ও শওকত ওসমানের সৌজন্যে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সেটি প্রকাশার্থে দিয়েছেন। নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা থেকে জুন, ১৯৮৮-এ প্রকাশিত ‘সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন কর্তৃক সেটি পুনর্মুদ্রিত হয়। রিপোর্টের তারিখ ১২ আগস্ট ১৯৫৩।
১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আগ্রহে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ ভ‚মিকায় ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুলকে তার জন্মবার্ষিকীর শুভলগ্ন সামনে রেখে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি’র মর্যাদায় ঢাকায় আনা হয় (১০ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭৯)। কবির পুত্রবধূ উমা কাজীও নজরুলের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে নজরুল ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিশেষ ফোকার ফ্রেন্ডশিফ বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করলে অপেক্ষমাণ কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের বিপুল জনতা গগনবিদারী স্লোগান দিয়ে নজরুলকে স্বাগত জানান এবং অজস্র ফুলের মালা, ডালি ও স্তবক দিয়ে কবিকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। কবিকে ঢাকার ধানমন্ডিতে সরকারি একটি বাড়িতে [সড়ক-২৮, বাড়ি-৩৩০/বি, ধানমন্ডি, পরে ‘কবিভবন’] রাখার ব্যবস্থা করা হয়। অ্যাম্বুলেন্সে করে এখানে আনার পর বিপুল ভিড়ের মধ্যে কবিকে অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানাতে আসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
Advertisement
ঢাকায় কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয় এবং কবিভবনে প্রতিদিন জাতীয় পতাকা উড্ডীন রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কবিভবনে কবিকে নিয়মিত গান শোনানো ও গাড়িতে করে বাইরে বেড়িয়ে আনার ব্যবস্থা ছিল। কবির জন্য দোতলা বাড়ি, একটি গাড়ি, ডাক্তার, নার্স এবং সেবাশুশ্রƒষার সব রকমের ব্যবস্থা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে কবির জন্য মাসিক ১ হাজার টাকা ভাতা প্রদানের কথা ঘোষণা করেন। কবির চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। ডা. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত ওই বোর্ডের সদস্যরা হলেন ডা. ইউসুফ আলী, ডা. নাজমুদ্দৌলা চৌধুরী ও ডা. আলী আশরাফ।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকায় বঙ্গভবনে আয়োজিত এক বিশেষ সম্মাননা অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ নজরুলকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১ জুন তৎকালীন প্রেসিডেন্টের অনুমতিক্রমে ডা. বায়োজিদ খান পন্নী কবির হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা শুরু করেন। এই চিকিৎসা ১০ আগস্ট পর্যন্ত চলে। ১৯৭৫ সালের ২২ জুলাই বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগের তদানীন্তন মহাপরিচালক ডা. মেজর এ চৌধুরী কবিকে দেখতে ধানমন্ডির কবিভবনে যান। তিনি সার্বক্ষণিক চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের সুবিধার জন্য ঢাকার পিজি হাসপাতালে কবিকে স্থানান্তরিত করার নির্দেশ দিলে ১১৭ নম্বর কেবিনে নজরুলকে ভর্তি করা হয়। বাংলাদেশে কবির আড়াই বছরের বাসগৃহ জীবনের অবসান ঘটে। হাসপাতালের বেডই হয় কবির শেষ আশ্রয়। এ সময়ে ডা. নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে সেবিকা শামসুন্নাহার কবির দুলু এবং সেবক ওয়াহিদুল্লাহ ভুইঞা কবির পরিচর্যা করেন। অভ্যাসের এই পরিবর্তনে স্বভাবতই কবির আকস্মিক শরীর-বিপর্যয় ঘটল। এক বছর হাসপাতালে কাটাবার পর জ্বর ও নিউমেনিয়া-জাতীয় রোগ আক্রমণ করল ৭৭ বছরের জীর্ণ শরীরটিকে। ঝাঁপিয়ে পড়লেন চিকিৎসকের দল। কিন্তু তাদের সব চেষ্টা, বিজ্ঞানের সব অস্ত্রকে ব্যর্থ করে জীবন্মৃত কবি-দেহটিকে ধীরে ধীরে মৃত্যু এসে গ্রাস করল।
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট রোববার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে কাজী নজরুল ইসলাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কাজী নজরুল ইসলাম নির্বাক অবস্থায় ৩৪ বছর ১ মাস ২০ দিন বেঁচে ছিলেন। কবিভবনে কবি কাটিয়েছেন ৩ বছর ১ মাস ২৯ দিন। কবিভবন থেকে কবিকে নিয়ে যাওয়া হয় পিজি হাসপাতালের ১১৭নং কেবিনে। পিজি হাসপাতালে কবি মৃত্যু পর্যন্ত অর্থাৎ ৬ মাস ১১ দিন কাটিয়েছেন।
দুইকবি নজরুল সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণা করতেন। জীবনে বহুবার তিনি সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার হয়েছেন। বেঙ্গলি রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর নজরুল ইসলাম করাচি থেকে সোজা কলকাতা আসেন এবং রমাকান্ত বোস স্ট্রিটে বাল্যবন্ধু শ্রীশৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে বোর্ডিং হাউসে ওঠেন। নজরুল সেখানে তিন-চার দিন ছিলেনও। ইতোমধ্যে বোর্ডিং হাউসের চাকর জানতে পারে যে, নজরুল ইসলাম একজন মুসলমান। সে তার এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করে। যার ফলে নজরুলকে ঐ আস্তানা ছাড়তে হয়। ৩২, কলেজ স্ট্রিটের দোতলায় রাস্তার দিককার অংশে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল। এই সমিতি অফিস থেকে একখানা ত্রৈমাসিক মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বের করা হতো। সমিতির সহকারী সম্পাদক এবং সমিতির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে মুজফ্ফর আহমদ সমিতির অফিসেই থাকতেন। শেষ পর্যন্ত ঐ সমিতি অফিসেই মুজফ্ফর আহমদের সঙ্গে নজরুল ইসলামের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ প্রকাশের পর থেকে অর্থাৎ, ১৯১৮ সালের এপ্রিল-মে মাস থেকেই ৪৯ নম্বর বেঙ্গলি রেজিমেন্টের অনেকেই সাহিত্য পত্রিকার সাথে পত্রালাপ করত। এর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম।
Advertisement
তিনকবি নজরুল নিয়ে অনেক অজানা বিষয় রয়েছে। জীবনে তিনি কত কি না করেছেন। সাহিত্য, সংগীতের এমন কোনো দিক নেই যেটাতে তিনি দক্ষতার পরিচয় দেননি। ‘মৌনী ফকির’ কাজী নজরুল ইসলমের প্রথম কবিতা। মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি সেটি রচনা করেন। কবি তখন আসানসোল রুটির দোকানের কর্মচারী। সুস্থ অবস্থায় কাজী নজরুল ইসলামের লেখা সর্বশেষ কবিতা গ্রন্থটির নাম ‘নতুন চাঁদ’। নজরুল ইসলামের সুস্থাবস্থায় প্রকাশিত সর্বশেষ কাব্যের নাম ‘নির্ঝর’। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে এটি প্রকাশিত হয়। প্রথম বিয়ের ঘটনার পর ১৯২১ সালের ১০ জুলাই কমরেড মুজফ্ফর আহমদ কুমিল্লা থেকে নজরুলকে কলকাতায় নিয়ে এসে তালতলা লেনের বাড়িতে নিজের সাথেই রাখেন। ঐ বাড়িতে থাকার সময় সম্ভবত ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষরাতে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি রচনা করেন। কমরেড মুজফ্ফর আহমদ ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রথম শ্রোতা। কবি নজরুল ইসলামের মুখে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে আলিঙ্গন করেছিলেন। সুদূর করাচি থেকে পাঠানো গল্প ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম গল্প। সেটি মাসিক সওগাত-এর প্রথম বর্ষ, সপ্তম সংখ্যা (১৯১৯ সালের মে-জুন) প্রকাশিত হয়।
কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ের পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। নিজে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ না হলেও তার অসামান্য মেধা ও ভাষাসাহিত্যে অসাধারণ পাÐিত্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এই দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।
১৯৩৪ সালে বিবেকাননন্দ রোডে গ্রামোফোন রের্কডের দোকান দিয়েছিলেন। দোকানের নাম দিয়েছিলেন ‘কলগীতি’। দিনের পর দিন বাকিতে রেকর্ড দিয়ে অবশেষে এই ব্যবস্যা লাটে ওঠে।
৩২, কলেজ স্ট্রিটে থাকার সময়ে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে সাব-রেজিস্ট্রার পদের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ লেটার পেয়েছিলেন। কিন্তু আফজালুল হক ও মুজফ্ফর আহমদের আপত্তিতে নজরুল ইন্টারভিউ দিতে যাননি। সেনাবাহিনী থেকে ফিরে আসার পর ৩২, কলেজ স্ট্রিটে মুসলিম সাহিত্য সমিতির ভাড়া বাড়িতে কমরেড মুজফ্ফর আহমদের সাথে নজরুলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেই সময়ে অর্থাৎ ১৯২০ সালের মার্চ মাসের কোনো এক রাতে নজরুলের গাওয়া প্রথম হিন্দি গানটি মুজফ্ফর আহমদ শুনেছিলেন। ১৯১০ (বা ১৯০৬) সালে ঋষি অরবিন্দ তার সম্পাদিত ‘বন্দে মাতরম’ পত্রিকায় প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন। তার অনেক পরে হাসরত মোহানী করাচি কংগ্রেস অধিবেশনে ঐ দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তা গৃহীত হয়নি। বরং এই দাবি উত্থাপন করার জন্য ১৯২২ সালের ১১ জুলাই হাইকোর্টের রায়ে তার সাজা হয়। ১৯২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ‘ধূমকেতুর পথ’ শীর্ষক লেখায় কাজী নজরুল ইসলাম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি পুনরায় উত্থাপন করেন।
১৯৪২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২২ বছর সময়কে কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের অন্ধকারময় যুগ বলা হয়। কারণ ঐ সময়ে কবির রচিত গান প্রায় কেউ গাইত না। রেডিওতেও প্রচার হতো না। তখন কবির রচিত ও সুরারোপিত গান মাঝেমধ্যে অন্যের নামেও প্রচারিত ও প্রকাশিত হতো।
১৯৩১ সালে ছয় সিলিন্ডারবিশিষ্ট একটি ক্রাইসলার মোটরগাড়ি ক্রয় করেন। গাড়িতে চড়ার শখ কবির বরাবরই ছিল। আর্থিক অবস্থা একটু ভালো হতেই সেই শখ কবি পূরণ করেন। কিন্তু তার এই অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। স্ত্রী প্রমীলা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তার চিকিৎসার জন্য গাড়ি এবং পূর্বে ক্রয় করা বালিগঞ্জের জমিটিও বিক্রি করে দিতে হয়। কাজী নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালী দেবী মেয়ের পরিবারে প্রায় ২২ বছর ছিলেন। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে যখন কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে সেই সময়ে হঠাৎ একদিন গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। তাকে আর কখনোই পাওয়া যায়নি।
চারকবি নজরুল রচিত অজস্র গানের সুরগুলোকে লোপাট করে দিয়ে তার পরম ভক্ত ও শিষ্যরা নতুন সুর বসিয়ে নজরুলের নামে চালিয়ে তুমুল কাঁচা পয়সার ব্যবসা করেছে। তাই রেকর্ড কোম্পানিগুলো দু-নম্বরি নজরুলদের নিয়েই সন্তুষ্ট। খাঁটি নজরুল তাদের কাছে অনুৎপাদক অহল্যা-জমিন। প্রকাশকদের কোনো দায় বা চক্ষুলজ্জা নেই বিক্রিত গ্রন্থের রয়্যালটি কবির হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। যে পারে সামান্য কয়েক খণ্ড রজতমুদ্রার বিনিময়ে যেখানে যা অবশিষ্ট পাণ্ডুলিপি ছিল, সে বা তারা হস্তগত করে সরে পড়েছে। পারিবারিক শুভানুধ্যায়ী জুলফিকার হায়দারের স্মৃতি অন্তত তাই বলে।
মোহাম্মদী পাবলিকেশনস-এর অধিকারী আকরম খাঁ, যিনি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে সিরাজ-উদ-দৌলার স্মৃতি রক্ষার্থে তৎপর হয়েছিলেন, এমনকি তারও আগে যিনি মাসিক মোহম্মদীকে নজরুলমেধ যঞ্জের অশ্ব করে পথে ছেড়েছিলেন, তারই পুত্র গুণধর খারুল আনাম খাঁ (ছদরুল আনাম খাঁ) আড়াই’শ টাকা গছিয়ে ‘নতুন চাঁদ’-এর প্রথম সংস্কারণের ২ হাজার ২০০ কপি মুদ্রণস্বত্ব হস্তগত করে। এই যৎকিঞ্চিৎ অর্থ প্রকাশকের হাত থেকে বোধহয় নজরুলের ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। ঋণের তপ্ত বালুই তার প্রায় সবটা শুষে নিয়েছিল বলে আশঙ্কা হয়।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এইচআর/জেআইএম