১৪ বছরের নলীন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। জীবন তার ওষ্ঠাগত। ককিয়ে ককিয়ে চিৎকার করছিল। তার বাবা অনীল কুমারও ঘাড়ে কোপ নিয়ে বেঁচে আছেন ততক্ষণ। নিজেই গর্ত থেকে উঠতে পারছেন না, তার ওপর ছেলের চিৎকার। জীবন বাঁচাতে ছেলেকে ফেলেই উঠে এলেন অনীল।কোনোমতে একটি কাঁথা বা কম্বল এনে ছেলেকে ঢেকে দিয়ে পিতৃস্নেহে বারবার পিছু তাকালেও চোখের পানি মুছতে মুছতে পালিয়ে ভারতে চলে গেলেন অনীল। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জাঠিভাঙা বধ্যভূমির পাশের নদীতে বাঙালিদের হত্যা করে ফেলে রাখা হতো। সেখানেই খুন করা হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার নিরীহ মানুষকে। তাদেরই একজন অনীল। এ ঘটনা আজও এলাকাবাসীর মনে দাগ কেটে আছে।আজ (বৃহস্পতিবার) ৩ ডিসেম্বর। এই দিনে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের পরাজিত করে ঠাকুরগাঁও মহকুমা শত্রুমুক্ত করে। কিন্তু এরই মধ্যে ৯ মাসের যুদ্ধে শহীদ হন ঠাকুরগাঁওয়ের প্রায় ২৫ হাজার মানুষ। ৭১`র ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় এ এলাকার মানুষও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গঠন করা হয় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি। গড়ে তোলে দুর্বার প্রতিরোধ।১৫ এপ্রিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে পাকবাহিনী ঠাকুরগাঁওয়ে প্রবেশ করলে তাদের দখলে চলে যায় এ জনপদটি। তারা ১০টি ট্রাক ও ৮টি জিপে করে মুহুর্মুহু শেল বর্ষণ করতে করতে ঠাকুরগাঁওয়ে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট আর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা।হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা সবচেয়ে বড় গণহত্যাকাণ্ড চালায় সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গ্রামে। সেখানে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী আশপাশের ৪/৫টি গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার নিরীহ গ্রামবাসীকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে ধরে নিয়ে আসে। সেখানে তাদের একত্র করে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে তাদের লাশ মাটিতে চাপা দেয়। এর মধ্যে অনেকেই জীবিত ছিলেন। পাক সেনারা চলে যাওয়ার পর জীবিত চারজন মাটি ঠেলে উঠে আসেন। শুকানপুকুর এলাকায় কয়েক হাজার অবাঙালি ও অস্থানীয় লোক ভারত অভিমুখে যাওয়ার সময় পাথরাজ নদী এলাকায় তাদের আটক করে স্বর্ণালংকার লুটপাট চালিয়ে হত্যার পর তাদের লাশ নদীতে গণকবর দেয়া হয়।ঠাকুরগাঁও চিনিকলের দুই কর্মচারী ও কৃষি ব্যাংকের একজন গার্ডকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয় সুগার মিল এলাকায়। রামনাথ এলাকায়ও চালানো হয় গণহত্যা। এরপর পীরগঞ্জ থানার আওয়ামী লীগ নেতা ডা. সুজাউদ্দীন, বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা, আতাউর রহমান, আব্দুল জব্বার ও মোজাফ্ফর আলীসহ সাতজন রাজনৈতিক নেতাকে ধরে এনে পীরগঞ্জ-ঠাকুরগাঁও পাকা সড়কের তেঁতুলতলা নামক আখফার্মে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন সময়ে এ থানার প্রায় তিন হাজার নিরীহ মানুষকে স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ক্যাম্পে ধরে এনে তাদের হত্যা করে জগথা রাইস্ মিল ও সরকারি কলেজের পার্শ্বে মাটিচাপা দেয়া হয়। ভোমরাদহ ইউনিয়নের দেশিয়াপাড়া নামক স্থানে স্থানীয় শতাধিক হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে গণহত্যা চালানো হয়। পরে তাদের লাশ একই গর্তে মাটি চাপা দেয়া হয়।জেলার রানিশংকৈল থানা ক্যাম্পের শত্রুবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ হাজার লোককে ধরে এনে খুনিয়াদিঘি নামক পুকুর পাড়ে সারিবদ্ধ করে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে তাদের লাশ পুকুরের পানিতে ভাসিয়ে দেয়। গুলি করার আগে তাদের পুকুরপাড়ের একটি শিমূল গাছের সঙ্গে হাতেপায়ে লোহার পেরেক গেঁথে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন খবর জানতে বর্বর নির্যাতন চালায়। এলাকার প্রবীণ ব্যক্তিদের কাছে সেদিনের কথা শুনে এখনও মানুষের গা শিউরে ওঠে। তখন থেকেই ওই পুকুরটি খুনিয়াদিঘি নামে পরিচিত।এদিকে বালিয়াডাঙ্গী থানার মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক আলহাজ্ব দবিরুল ইসলামের (বর্তমান এমপি) পিতা আকবর আলীকে বাড়ি থেকে ধরে এনে গুলি করে হত্যা করে লাশ তিরনই নদীতে ফেলে দেয়। ঝিকরগাছা গ্রামের ২৫ নিরীহ লোককে বাড়ি থেকে ডেকে এনে বালিয়াডাঙ্গী ক্যাম্পে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। হরিপুর থানার শাইফুদ্দীন, মহিরউদ্দীন, নুরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, মজিবর রহমান ও তার ভাই এবং হরিপুর মসজিদের ইমামসহ প্রায় শতাধিক ব্যক্তিকে হরিপুর পাকবাহিনীর ক্যাম্পে ধরে আনা হয়। কিন্তু সেখান থেকে কেউ আর ফিরে আসেননি।হরিপুরের ঝিগড়া গ্রাম, কুসলডাঙ্গীর বহু মানুষকে একসঙ্গে ডেকে বেয়নেট দিয়ে খুটিয়ে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। কামারপুকুর নামক এলাকায় প্রায় অর্ধশত হিন্দু-মুসলিমকে একসঙ্গে গণকবর দেয়া হয় বলে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানিয়েছেন। ২৯ নভেম্বর এ মহকুমার পঞ্চগড় থানা প্রথম শত্রুমুক্ত হয়। পঞ্চগড় হাতছাড়া হওয়ার পর পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে গেলে তারা পিছু হটে ময়দানদিঘি, বোদা, ভুলণ্ডী হয়ে ঠাকুরগাঁওয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ আক্রমণ চলতে থাকে সেখানে।পাক সেনারা ৩০ নভেম্বর ভুলণ্ডী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। তারা সালন্দর এলাকার সর্বত্র বিশেষ করে আখ ক্ষেতে মাইন পেতে রাখে। মিত্রবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ব্রিজ মেরামত করে ট্যাঙ্ক পারাপারের ব্যবস্থা করে। ১ ডিসেম্বর ব্রিজ পাড় হলেও মিত্রবাহিনী যত্রযত্র মাইনের কারণে ঠাকুরগাঁও শহরে ঢুকতে বিলম্ব হয়। ওই সময় শত্রুদের মাইনে দুটি ট্যাংক ধ্বংস হয়। পরে কমান্ডার মাহাবুব আলমের নেতৃত্বে মাইন অপসারণ করে মিত্রবাহিনী ঠাকুরগাঁও শহরের দিকে অগ্রসর হয়। ২ ডিসেম্বর প্রচণ্ড গোলাগুলির পর শত্রুবাহিনী ঠাকুরগাঁও থেকে পিছনে হটে যায়। ৩ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী বিজয়ের বেশে ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করে।জেলার বিভিন্ন থানা ও গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক স্থানে গণহত্যা চালায় পাকবাহিনী ও তার দোসররা। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের মধ্যে পীরগঞ্জের অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফার স্মরণে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করলেও তার সমাধিস্থল সংরক্ষণে কোনো সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পারিবারিকভাবে ইট দিয়ে সেখানে সমাধিস্থল চিহ্নিত করে রাখা হলেও সেটি অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে। দখল হয়ে যাচ্ছে জমি।শহীদ বুদ্ধিজীবীর ছেলে আসাদুজ্জামন আসাদ জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রেখেও আজও সমাধিটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে এক শ্রেণির মানুষ সমাধির পাশের জায়গাটিও দখল করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।সদর উপজেলার জাঠিভাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম জানান, বদ্ধভূমি নির্মাণ করা হলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেই। চুরি হয়ে যাচ্ছে লোহার গেট। এখনো বদ্ধভূমির পাশের জমি থেকে পুঁতে রাখা লাশের হাড় পাওয়া যাচ্ছে। এই এলাকায় যারা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তারা এখনো প্রভাবশালী। তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম।জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জীতেন্দ্র নাথ রায় জানান, বর্তমান সরকার কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিয়েছে বাকিরা বিচার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তা প্রসংশার দাবিদার। দ্রুত এই প্রক্রিয়া কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।ঠাকুরগাও প্রেসক্লাব সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আখতার হোসেন রাজা জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এই বাংলার মাটিতেই হবে। তা না হলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস মুছে যাবে।উল্লেখ্য, ঠাকুরগাঁও জেলা হতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল প্রায় এক হাজার ৬শ জন। তার মধ্যে ২শত জন শহীদ হন মুক্তিযুদ্ধে। এখন পর্যন্ত ভাতা পাচ্ছেন এক হাজার ৪শ দুই জন মুক্তিযোদ্ধা। ঠাকুরগাঁওয়ে গণকবরের সংখ্যা আনুমানিক ১৫টি। এখনো গণকবরের গণনা চলছে।স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও ঠাকুরগাঁওয়ের বদ্ধভূমিগুলো আজও চিহ্নিতকরণ করা হয়নি। যে গুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো অবহেলা আর অযত্নে পড়ে আছে। এগুলো সংস্কার, সংরক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানান জেলার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা।রবিউল এহসান রিপন/বিএ
Advertisement