ফাতিহুল কাদির সম্রাট
Advertisement
১১ দিন পর থেমেছে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধে জয় দাবি করছে হামাস ও ইসরাইল দু’পক্ষই। আসলে এ যুদ্ধে জয়ী কোনো পক্ষ নেই। কিন্তু লাভবান পক্ষ আছে। এ যুদ্ধে পরাজিত পক্ষও আছে, সেটি ইসরাইল বা হামাস নয়— মানবতা ও মনুষ্যত্ব।
১১ দিনের যুদ্ধে ফিলিস্তিনে ৩৫৭ জন নিহত ও প্রায় দুহাজার মানুষ আহত হয়েছে। নিহতদের অর্ধেকই নারী ও শিশু। লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছে। গাজার অর্ধেকটা ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ ও পানিসরবরাহ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পরিষেবা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অপর দিকে ইসরাইলে মারা গেছে ১৪জন। আহত হয়েছে আরো ৩৩০ জন। তুলনামূলকভাবে কম হলেও ইসরাইলেও ঘরবাড়ি ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
যুদ্ধ শুরুর পর অনেকেই বলেছেন ইসরাইলে আগে রকেট ছুঁড়ে হামাস বাঘের লেজ দিয়ে কান খোঁচাতে গেছে। এখন ইসরাইল তাদের ধুলায় মিশিয়ে দেবে। সামরিক শক্তি বিচারে এমন ভাবনা ভুল নয়। প্রতিপক্ষ হিসেবে ইসরাইলের সাথে হামাসের তুলনা চলে না। বলা যায় মেশিনগানের সামনে লাঠি নিয়ে প্রতিরোধ করার মতো। ইসরাইল বিশ্বের প্রথম ২০টি সামরিক শক্তির অন্যতম। তাদের হাতে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ সংস্করণের অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি। আছে পরমাণু অস্ত্র। নিয়মিত ও অনিয়মিত মিলে সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৮লাখ।
Advertisement
অপরদিকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত পশ্চিম তীর ও গাজার মধ্যে কোথাও নেই স্বীকৃত সেনাবাহিনী। নেই ভারী কোনো অস্ত্র। পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণ করেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস যিনি আমেরিকা ও ইসরাইলের আজ্ঞাবহ। প্যালেস্টাইন কর্তৃপক্ষ (পিএ)-র নামে স্বীকৃত চ্যানেলে আসা বিদেশি সাহায্য ভাগবাটোয়ারা তাঁর মূল কাজ। পশ্চিম তীরে পুলিশ বাহিনী থাকলেও তাদের হাতে অস্ত্র নেই। ইসরাইল সরকার যে অস্ত্র পুলিশকে দিয়েছে তাকে বলা যায় বাংলাদেশের আনসারের বা দারোয়ানের হাতে গুলিবিহীন মরচেধরা বন্দুকের মতো।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জেতার পরেও হামাসকে ক্ষমতা না দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সেবাদাসরূপে প্রেসিডেন্ট পদ আঁকড়ে আছেন আব্বাস। গাজায় মাহমুদ আব্বাস ভীরু-কাপুরুষ হিসেবে পরিচিত। এখানে শুধু তাঁর নয় ইসরাইলেরও পাত্তা নেই। ইসলামিক জিহাদের আছে স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা। অনমনীয় তাদের মনোবল। তাদের স্বদেশপ্রেম নিখাঁদ। আত্মরক্ষা ও শত্রু প্রতিরোধের জন্যে তাদের প্রধান শক্তি জিহাদি চেতনা এবং আত্মদানের প্রেরণা। আর আছে নিজেদের গোপন ওয়ার্কশপে তৈরি বেশ কিছু রকেট ও মিসাইল। এক সময় মিসর থেকে কিছু অস্ত্র তারা পেত চোরাইপথে। ইসরাইল ছাড়া কেবল মিসরের সাথেই আছে প্যালেস্টাইনের স্থল সীমান্ত। সুড়ঙ্গপথে মাটির নিচ দিয়ে মিসর থেকে গাজায় আসত অস্ত্র এবং চিকিৎসাসামগ্রী। মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে সীমান্ত খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিলে আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের মিত্ররা প্রমাদ গোনে।
পরিকল্পিতভাবে মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে তারা ক্ষমতায় বসায় শিখণ্ডি আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে। সিসি সমস্ত সুড়ঙ্গ বন্ধ করে দিয়েছেন। সীমান্তে তুলেছেন ঢালাই দেওয়া দেওয়াল। স্থলপথে প্যালেস্টাইনিদের জন্যে একটি ম্যাচবাক্স আসলেও তা আসে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের হাত হয়ে। তবে চলমান সংঘাতে প্রমাণিত হয় যে, হামাস তলে তলে লেবাননের হিজবুল্লাহ বা ইরানের কাছ থেকে অস্ত্র এবং মিসাইল প্রযুক্তির সবক পেয়েছে নিশ্চিত।
অবরুদ্ধ গাজাকে মাটিতে মিশিয়ে ফেলা ইসরাইলের জন্যে কঠিন কিছু নয় অন্তত সামরিক শক্তির বিচারে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য সংকটের প্রকৃতি যারা বুঝেন তারা ঘোর যুদ্ধের সময়েও ভাবেননি যে, এ যুদ্ধে জয়পরাজয়ের ফয়সালা হবে। সচেতন মহল ঠিকই জানেন, এটা একটা পাতানো খেলামাত্র। উইন উইন একটা জায়গায় গিয়ে বিরতির বাঁশি বাজবে। এই বাঁশির পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুঁ। সর্প হইয়া দংশন করে ওঝা হইয়া ঝাড়া আমেরিকার কাজ। সে মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বলয় ধরে রাখার জন্যে ফিলিস্তিন-ইসরাইল বৈরি সম্পর্ক সজীব রাখতে তৎপর। তাই তার অনুগত মিসরকে দিয়ে প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করিয়েছে। দুপক্ষই করছে বিজয় উল্লাস। সত্যি এক অসাধারণ উইন উইন রফা।
Advertisement
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিন ও দক্ষিণ এশিয়ার কাশ্মীর সংকট কখনোই মিটবে না। এ দুটি জায়গা নিয়ে বিরোধ জিইয়ে রাখা অনেক পক্ষের জন্যে লাভজনক। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পে পাঁচী নাম্নী ভিখারিণী তার এক পায়ের হাঁটুর নিচে ঘা সযত্নে দগদগে করে রাখে, শুকাতে দেয় না। কারণ এই ঘা তার ভিক্ষাকারবারের মূল পূঁজি। কাশ্মীর ইস্যুর নিষ্পত্তি হলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রভাব জলো হয়ে যাবে। রাজনীতির মাঠে ক্ষমতার সিঁড়ি হারিয়ে যাবে। ভারতের মিডিয়া হারাবে সবসময়কার তাজা খবর, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি হারাবে পাকিস্তানবধের জিকির। তেমনি ফিলিস্তিন ইস্যু মিটে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মোড়লগিরির ছুতোটি আর থাকবে না। অস্ত্র ব্যবসার টার্নওভার তলানিতে নামবে। ইসরাইলের রাজনীতি ও ক্ষমতারোহণের প্রাণভোমরাটি মারা যাক তা নেতানিয়াহুরা কখনো চাইবেন না।
এই যুদ্ধটি নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি উপলক্ষ। মোদি আর নেতানিয়াহু দুজনই এখন উগ্রজাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় জজবাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইছেন। পাক-ভারত ও চীন-ভারত সীমান্তে উত্তেজনা না থাকলে মোদির গদি টলোমল হয়ে যেত কবে। নেতানিয়াহু তো আছেন পুলসিরাতের ওপর। নির্বাচনে তাঁর দলের নেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মাথার ওপর ঝুলছে দুর্নীতি মামলার খড়গ।
অপর দিকে হামাসের সময় কাটছিল পানসে পানসে। ২০১৪-র পর ব্যবহার না করায় অস্ত্রে ধরেছে মরচে। ঝিমিয়ে পড়েছিল জিহাদি জজবা। এই যুদ্ধ না হলে হামাস নতুন করে তার অস্তিত্ব জানান দিতে পারত না। যুদ্ধের সুবাদে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান অবিসংবাদিত করে তোলার সুযোগ পেয়েছে হামাস। মূলত যুদ্ধবিরতি হয়েছে হামাসের সাথে ফিরিস্তিনের সাথে নয়। এর মধ্য দিয়ে হামাসের রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ হলো। ইসরাইল ও তার পক্ষবলয় হামাসকে কিন্তু সন্ত্রাসী সংগঠন ছাড়া আর কিছু বলে না। অথচ সেই হামাসের অন্তত দুটি শর্ত মেনে যুদ্ধবিরতি হয়েছে। কাজেই হামাসের নগদ লাভটা বেশিই বটে। ওদিকে মাহমুদ আব্বাসও এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফাও হিসেবে পেয়েছেন লাভের ভাগ। তিনি যে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট সেটি তিনি বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে জানান দিতে সক্ষম হয়েছেন। বাইডেন তাঁকে ফোন করেছেন। আমেরিকা, ইসরাইল ও পশ্চিমা বিশ্বের তাবেদারি করে আব্বাস ক্ষমতাকে আরেকটু সংহত করলেন বটে। যুদ্ধপরবর্তী সাহায্যের অর্থও কিছু জুটবে কপালে।
এই যুদ্ধে একটি বিষয় সামনে এসেছে সেটি হলো ইসরাইলের ডেমোগ্রাফিক বিভাজন এবং জাতীয় সংহতির দুর্বলতা। বিখ্যাত পিউ রিসার্চ ইসরাইলের নাগরিকদের বিভাজনজনিত জাতিগত দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগজনক প্রমাণ হাজির করেছে। ইসরাইলের মোট জনসংখ্যা এক কোটির নিচে। তার মধ্যে ৬৭ লাখ ইহুদি। ২০ লাখের কিছু বেশি মুসলমান। অন্যরা খ্রিষ্টান, বাহাই ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী। ইহুদিদের মধ্যে ধর্মীয় ফেরকা আছে প্রধানত চারটি। আছে ভাষা, বর্ণ ও আগমনের উৎস অনুযায়ী বিভক্তি। নেটিভ ইহুদিরা প্রধানত হিব্রুভাষী। নেটিভদের মধ্যে আরবিভাষীও আছে।
ইউরোপ থেকে আগতদের বেশিরভাগের ভাষা ইংরেজি, স্পেনিশ, জার্মান ও পোলিশ। সিরিয়া ও ইয়েমেন থেকে আসা ইহুদিদের ভাষাও আরবি। বেদুঈন আরবীয়দের গাত্রবর্ণ ঘোর কালো, আরব বংশোদ্ভূতরা গৌরবর্ণের, কালোকেশী আর ইরোপীয়দের অনেকে সাদাটে ফর্সা, চুল ব্লন্ডি। বরাবর ক্ষমতায় থাকা ইউরোপ থেকে আসা সেটলার ইহুদিরা নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে সরকার যুদ্ধ করেছে কিন্তু জনগণের বেশিরভাগ এ যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল। উগ্র জাতয়ীয়তাবাদীরা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে আর মডারেট ও অসাম্প্রদায়িকরা প্রভাব বিস্তার করছে। এবারের যুদ্ধে ইসরাইলের মুসলিম নাগরিকরা সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের ওপর হামলা হয়েছে। শতকরা প্রায় একুশ ভাগ মুসলমান ভেতর থেকে ফুঁসে উঠলে জাতীয় সংহতি হুমকির মুখে পড়তে বাধ্য।
পৃথিবীর একমাত্র কৃত্রিম রাষ্ট্র ইসরাইল। এর জনগণ রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে বাঁধা, অভিন্ন রক্তস্রোতের প্রবাহে পরিস্রুত নয়। কাজেই এই রাষ্ট্র অখণ্ড জাতীয়তার শক্তিতে উজ্জীবিত সহজে হবে না। শুধু সামরিক শক্তি দিয়ে চারপাশে বৈরিশক্তির শ্যেন দৃষ্টির মাঝে একটি রাষ্ট্র টিকে থাকা দুরূহ। কিন্তু ঐক্যহীন আরবদের কারণে হয়তো ইসলাইলের টিকে থাকা কঠিন হবে না।
চলমান যুদ্ধে হামাস যে শক্তি প্রদর্শন করেছে সেটা ইসরাইলকে ভাবাচ্ছে নিশ্চয়। সে হামাসকে আর বাড়তে দিতে চাইবে না। অপরদিকে হামাস সাহসী ও উজ্জীবিত। সেও চাইবে তার শক্তি জানান দিতে। তাই আপাতত জয়পরাজয় তোলা রইল আগামী আরেকটি যুদ্ধের জন্যে। হয়তো তখনো নিষ্পত্তিহীন থাকবে সেই যুদ্ধ। তখনো নারী-শিশুসহ অনেক নিরপরাধ মানুষের জীবন ঝরে যাবে। ভূলুণ্ঠিত হবে শুভবুদ্ধি, সুচেতনা এবং মানবতা।
আমরা চাই যুদ্ধের জয় নয়, মানবতার জয়। কিন্তু বিবেকহীন বিশ্বসম্প্রায়ের কাছে আমাদের চাওয়ার কোনোই মূল্য নেই।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, বাংলা, লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ।
এইচআর/এএসএম