রবিন জামান খানের জন্ম ১৯৮৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে। বাবা মালেকুজ্জামান খান, মা সাজেদা বেগম। পড়াশোনা করেছেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুল ও ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। পরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেন। এরপর ভাষাতত্ত্বের ওপর দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা বিভাগ থেকে।
Advertisement
তিনি এ সময়ের জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক হিসেবে পরিচিত। পাশাপাশি শিক্ষকতা ও গবেষণায় দারুণ সফল। বেশ কয়েক বছর ঢাকার একটি প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ফুল ফান্ড স্কলারশিপে পড়াশোনা করছেন ফলিত ভাষাতত্ত্ব ও প্রযুক্তি নিয়ে।
সম্প্রতি তার বিদেশে পড়াশোনা ও ক্যারিয়ারের সফলতা নিয়ে কথা হয় জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ও কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?রবিন জামান খান: আমার ছোটবেলাটা বেশ বৈচিত্রময় ছিল। কারণ বাবার ট্রান্সফারের সুবাদে বহু জায়গায় থাকার সুযোগ হয়েছে। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা হলেও বড় হয়েছি ঢাকা, বগুড়া এবং ময়মনসিংহে। বিশেষ করে আমার শৈশবের একটি বড় অংশ কেটেছে বগুড়ায়। সেই সময়টা অনেক দারুণ ছিল। বাবার চাকরির সুবাদে অনেক জায়গায় যাওয়ার ও থাকার সুযোগ হতো। মেশার সুযোগ হতো বহু মানুষের সঙ্গে।
Advertisement
জাগো নিউজ: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?রবিন জামান খান: নাহ, ছোটবেলা থেকে আমি একেবারে নিয়মিত ছিলাম পড়ালেখায়। এ কারণে কোনো স্টাডিগ্যাপ হয়নি কখনো। একেবারে ছোটবেলা থেকে খুব ভালো ছাত্র যাকে বলে; সেটা কখনোই ছিলাম না। তবে নিয়মিত ছিলাম সব সময়ই। পড়ালেখার এ ধারাবাহিকতা পরবর্তীতে ক্যারিয়ার এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দারুণভাবে কাজে দিয়েছে নিঃসন্দেহে।
জাগো নিউজ: বিদেশযাত্রা বা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?রবিন জামান খান: এটা নিয়ে বেশ মজার এবং চ্যালেঞ্জিং গল্প আছে। আমি অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালেয়ে। যেখানে বেশিরভাগ স্টুডেন্ট পড়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া স্টুডেন্টদের একটি অংশের টার্গেট থাকে অনার্স শেষ করেই জিআরই-আইইএলটিএস দিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য অ্যাপ্লাই করার। আমাদের দেশে একটি কথা খুব প্রচলিত যে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া বা সায়েন্সের স্টুডেন্টদের জন্য স্কলারশিপে দেশের বাইরে যাওয়া তুলনামূলক সহজ, আর্টস বা কমার্সের স্টুডেন্টদের জন্য সেটা নয়। অনার্সে পড়ার সময় থেকে আমার মনে হতো, এ স্টিরিওটাইপটা পুরোপুরি ঠিক নয়। তখন থেকে ভেতরে ভেতরে একটা চ্যালেঞ্জ কাজ করতো। আমি সাহিত্য নিয়ে পড়লেও ভবিষ্যতে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবো।
জাগো নিউজ: বিদেশযাত্রা বা উচ্চশিক্ষার গল্প শুনতে চাই—রবিন জামান খান: যদিও প্রাথমিক ধারণার বীজটা রোপিত হয়েছিল অনার্সে থাকতে। কিন্তু সেটা প্রস্ফুটিত হতে সময় লেগেছে বেশ অনেকটা। এর পেছনে কিছু কারণও ছিল। প্রথমত, আমি অনার্স এবং মাস্টার্স করেছি ইংরেজি সাহিত্যে, কিন্তু সাহিত্য নিয়ে পড়ালেখা করলেও আমার বেশি ভালো লাগতো ভাষা নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু সিলেটে সেই সুযোগ ছিল না। যে কারণে সিলেট থেকে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয়বার মাস্টার্স সম্পন্ন করি ইএলটি’তে। যেটাকে বাংলায় বলা যেতে পারে ফলিত ভাষাতত্ত্ব।
এরপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে জয়েন করি। সেখানে ধাপে ধাপে প্রমোশন পেয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হই তিন বছরের মাথায়। অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হতে হতে দেশি-বিদেশি বেশকিছু জার্নালে আমার অনেকগুলো অ্যাকাডেমিক পেপার পাবলিশ হয়। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে কোন ফিল্ডে কাজ করতে চাই, সেটার বিষয়েও মোটামুটি একটা ধারণা পাই। সিদ্ধান্ত নেই অ্যাপ্লায়েড লিঙ্গুইসটিক্স ও টেকনোলজি নিয়ে কাজ করবো ভবিষ্যতে। কিন্তু এ ফিল্ডে কাজ করতে গিয়ে একটা সমস্যা অনুভব করি; আমাদের দেশে ভাষা এবং প্রযুক্তির দিকটা ততটা ডেভেলপড নয়। ফলে আমি খুঁজতে শুরু করি কোথায় এটা নিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে।
Advertisement
ততদিনে লেখালেখিতেও খানিকটা খ্যাতি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের পাশাপাশি কলকাতায়ও বই প্রকাশ হতে শুরু করেছে। ফলে ওদিকটায়ও সময় দিতে হয়েছে। কিন্তু গবেষণার কাজও চলতে থাকে, পাবলিশ হয় আরও কয়েকটা পেপার। খোঁজ চলতে থাকে এবং জানতে পারি, আমি যে বিষয়ে কাজ করতে চাচ্ছি; তাতে পৃথিবীর সেরা কাজ হয় অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকায়। অস্ট্রেলিয়ার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করাতে সেখানে সুযোগও হয়, স্কলারশিপও হয় কিন্তু সেটা ছিল মাস্টার্সে। আমি দুটো মাস্টার্স ইতোমধ্যেই করেছি, কাজেই আরেকটা মাস্টার্স করতে চাচ্ছিলাম না। আর ওখানে আমার ফিল্ডটাও খানিকটা পরিবর্তন করতে হতো। ফলে ভালো অফার হওয়া সত্ত্বেও সাহস নিয়ে না করে দেই। আমেরিকার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।
একদিকে লেখালেখি, অন্যদিকে ফুল টাইম জব করে ব্যাপারটা কঠিন ছিল। একদিকে নানা পরীক্ষার প্রস্তুতি, সেইসঙ্গে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির অ্যাডমিশন অফিস ও প্রফেসরদের ই-মেইল করতে করতে একসময় পজিটিভ রেসপন্স পেতে শুরু করি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। এর ভেতরে ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগের টেসল বা অ্যাপ্লায়েড লিঙ্গুইসটিক্স প্রোগ্রামে ফুল ফান্ড এবং টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপসহ স্কলারশিপ হয়। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন হয় এবং তারা জানায় ফান্ডের বিষয়ে দ্রুতই জানানো হবে। কিন্তু তার আগেই কোভিড প্যানডেমিকে সব লকডাউন হয়ে যায়।
জাগো নিউজ: কবে কোন কারণে বিদেশে পারি জমিয়েছেন?রবিন জামান খান: আমি আমেরিকায় এসেছি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। এখন পিএইডি প্রোগ্রামের দ্বিতীয় সেমিস্টারে আছি। তো দেশের বাইরে আসার গল্পটা যেভাবে বলছিলাম; ওকলাহোমা স্টেট থেকে অফার লেটার পাবার কয়েকদিনের ভেতরেই প্যানডেমিক ছড়িয়ে পড়লো বিশ্বব্যাপি, লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেল সবকিছু। আমি অফার লেটার পাওয়ার পর যখন ভিসার জন্য কাগজপত্র রেডি করতে শুরু করবো, এমন সময় লকডাউনের কারণে সব থেমে গেল এবং ভিসা প্রসেস থেকে শুরু করে সবকিছু হয়ে গেল একেবারে অনিশ্চিত। বেশ কয়েক মাস এ অনিশ্চিত অবস্থায় কাটানোর পরিস্থিতি কিছুটা ভালো হওয়ার পর কাগজপত্র সব রেডি হলো কিন্তু অ্যাম্বেসি বন্ধ থাকার কারণে ভিসা নেওয়া সম্ভব হলো না। এ অবস্থায় বিশেষ আবেদন করে অ্যাডমিশন পেছাতে হলো, যেটাকে অ্যাকাডেমিক টার্মে ডেফার করা বলে। অ্যাডমিশন ফল থেকে ডেফার করে স্প্রিংয়ে নিয়েও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না, স্প্রিংয়েও যাওয়া যাবে কি-না। অনেক অনিশ্চয়তা আর শঙ্কা পার হয়ে অবশেষে ডিসেম্বরের শেষদিকে ভিসা হলো এবং ভিসা হওয়ার দুই সপ্তাহের ভেতরে ফ্লাই করলাম। এই মোটামুটি আমার পিএইডি শুরু করার গল্প।
জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?রবিন জামান খান: অনেকের কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি। অবশ্যই সবার প্রথমে পরিবারের কথা আসবে, আমরা পড়ালেখা কেন্দ্রিক পরিবার। আমার বাবা-মা সব সময়ই এ বিষয়ে অনুপ্রেরণা দিতেন, বিশেষ করে আমার বাবা। দিনের পর দিন পরিবারকে সময় না দিয়ে, সামাজিকতার ধার না ধরে লেখালেখি আর পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকতে পারতাম। কারণ আমার হয়ে সব ঝামেলা সামলে নিতো আমার স্ত্রী, তাকে বিশেষ ধন্যবাদ। পরিবারের বাইরে ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইফফাত আরা নাসরীন মজিদ ম্যাডাম, যে ডিপার্টমেন্টে কাজ করতাম তার ডিন, প্রফেসর তাহমিনা আহমেদ ম্যাডাম, শাবিপ্রবির প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর ডক্টর আলমগীর তৈমূর স্যার, তারা না থাকলে কোনোভাবেই আমার দ্বারা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব হতো না।
জাগো নিউজ: বর্তমান লেখালেখি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?রবিন জামান খান: আমি সব সময়ই বলি, বাই প্রফেশন আমি একজন শিক্ষক এবং বাই প্যাশন আমি একজন লেখক। কাজেই নিজের পেশাগত কোর্স ওয়ার্ক ও গবেষণার পাশাপাশি অবশ্যই আমি থ্রিলার লেখা চালিয়ে যেতে চাই। বিশেষ করে নালন্দা এবং অন্যধারা থেকে আমার যে দুটো উপন্যাসের সিরিজ প্রকাশিত হচ্ছে; সেগুলো নিয়মিত চালিয়ে যেতে চাই। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ও হিস্টোরিক্যাল থ্রিলার নিয়ে বাংলা ভাষায় অনেক কাজ করার আছে। এ দুটোকে আমি বাংলা সাহিত্যে ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই।
জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী? রবিন জামান খান: করোনাকালীন প্রাথমিক দিনগুলোয় আমি বাসায়ই ছিলাম। পরিবারকে সময় দিয়েছি, লেখালেখি করেছি। এর পাশাপাশি উত্তর শাহজাহানপুর মানে ঢাকায় আমি যেখানে থাকতাম; সেখানে আমার এলাকার ছোটভাইদের একটা সামাজিক সংগঠন আছে। সেটার মাধ্যমে আমরা অভাবগ্রস্ত মানুষকে নিজেদের জায়গা থেকে যতটা সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। এখন দেশের বাইরে থাকলেও তাদের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। ইচ্ছা আছে, ভবিষ্যতেও তাদের মাধ্যমে অভাবগ্রস্ত মানুষের সাহায্য করার। নিজের ক্ষুদ্র সামর্থ ও ক্ষুদ্র ক্ষমতা থেকে একজন মানুষকে একবেলার জন্য সাহায্য করতে পারাটাও অনেক বড় ব্যাপার।
এসইউ/এএসএম