সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ছয় ঘণ্টা আটকে রাখা, মামলা, গ্রেপ্তার, কারাগার, জামিন ঝুলিয়ে রাখা- সব ঘটনার আপাত সমাপ্তি ঘটলো তার জামিন এবং মুক্তির মধ্য দিয়ে। রোজিনার মুক্তি আপাত স্বস্তি এনেছে সবার মধ্যে। তবে রোজিনার মুক্তিতেই মুক্তি পাবে না গণমাধ্যম। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে। তবে এই ঘটনায় অনেকগুলো প্রশ্ন উঠে এসেছে, সামনে এসেছে অনেকগুলো পক্ষ।
Advertisement
প্রথম প্রশ্ন হলো, রোজিনা যা করেছেন, তা ঠিক না ভুল? রোজিনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় নথি চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রথম কথা হলো, ছয় ঘণ্টা আটকে রাখার এক পর্যায়ে রোজিনা স্বীকার করেছেন, তিনি ভুল করেছেন, প্রয়োজনে মুচলেকা দিতে তৈরি আছেন। ভিডিওর এই অংশ প্রচার করে অনেকে সুর তুলছেন, রোজিনা চোর এবং তিনি সেটা স্বীকারও করেছেন। তবে পুরো ভিডিওতে দেখা যায়, রোজিনা বলছেন, তিনি কোনো ডকুমেন্টসে হাত দেননি। তার সোর্স তাকে একটি নিউজের ডকুমেন্টস দিয়েছে। সচিবালয়ে আটকে রাখার সময় যারা তার ভিডিও করছিল, তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করে বলছিলেন, এই ভিডিও প্রচার হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। হয়েছেও তাই।
রোজিনা যাই বলুন, ধরে নিচ্ছি, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটা সত্যি। এটা কত বড় অপরাধ, তা আদালত বিবেচনা করবে। তবে সাধারণ দৃষ্টিতে চুরি করাকে, সেটা যাই হোক, অপরাধই মনে হবে। তবে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক যখন জনস্বার্থে কোনো তথ্য সংগ্রহ করে, তখন সেটাকে সাধারণ চুরি হিসেবে বিবেচনার সুযোগ নেই। যুগে যুগে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহের জন্য গোপন ক্যামেরা, ফাইলের ছবি তোলা, ফটোকপি করা, প্রয়োজনে সরিয়ে ফেলা, ছদ্মবেশ ধারণসহ নানান কৌশল অবলম্বন করে। তার সব কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করলে সাংবাদিকতা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে সাংবাদিকরা কোনো অফিসে গিয়ে টপাটপ ফাইল তুলে নিয়ে আসবে, সেটাও কোনো কাজের কথা নয়। প্রয়োজনটা বিবেচনায় নিতে হবে। একজন ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার চুরি করা যেমন অপরাধ নয়, তেমনি সংবাদক্ষুধায় আর্ত সাংবাদিকের জন্য তথ্য চুরি করাটাও সবসময় অপরাধ নয়। তবে মানুষও যেমন কাজ না করে ক্ষুধা পেলেই খাবার চুরি করবে না, তেমনি সাংবাদিকও সুযোগ পেলেই ফাইল চুরি করবে না। তথ্য সংগ্রহ আর নথি চুরির ফারাকটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এবং জটিলতা হলো, এই ঘটনায় কে কার পক্ষ, কে কার প্রতিপক্ষ। কাগজে কলমে এই মামলার বাদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমানী। আর একমাত্র আসামী প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার রোজিনা ইসলাম। কিন্তু আর সব ঘটনার মত এই ঘটনাটি অত সরল নয়। গত কয়েকবছরে বেশকিছু অনুসন্ধানী রিপোর্ট করে রোজিনা ইসলাম নিশ্চয়ই অনেককে শত্রু বানিয়েছেন। নিশ্চয়ই এই সুযোগে সেই শত্রুবাহিনীও সক্রিয় হয়েছে রোজিনাকে ঘায়েল করার জন্য। আবার এখানে প্রতিপক্ষ কি রোজিনা একা নন। সরকারের কোনো একটা অংশ নিশ্চয়ই এই সুযোগে প্রথম আলোকে শায়েস্তা করতে চেয়েছে। বা শুধু রোজিনা ইসলাম বা প্রথম আলো নয়; একজন রোজিনাকে হেনস্তা করে সাংবাদিকদেরই একটু টাইট দেয়া, একটু ভয় দেখানোর কৌশলও হয়তো ছিল। তবে সাংবাদিকরা রুখে দাঁড়ানোয় সে কৌশল পুরোপুরি সফল হয়নি।
Advertisement
লড়াইয়ের ভেতর যেমন অনেক লড়াই থাকে, ঘটনার ভেতরেও থাকে অনেক ঘটনা। রোজিনা ইস্যুতে আরেকটা লড়াই হয়েছে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের। সে লড়াইয়ে প্রাথমিকভাবে আমলাতন্ত্রেরই জয় হয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশ অনেকদিন ধরেই আমলাশাসিত। রাজনীতিবিদরা হাল ছেড়ে দিয়ে, আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন। নির্বাচন যখন নির্বাসনে, তখন রাজনীতিবিদদেরও কাজ কমে গেছে। এখন নির্বাচনে জিততে ভোট লাগে না, জনগণ লাগে না; তাই জনপ্রতিনিধিদেরও গুরুত্ব কমে গেছে। আমলাদের পরিকল্পনায়, পুলিশের বাস্তবায়নে নির্বাচনী নাটক হয়। তাই আমলারা যে সরকার গঠন করে, সে সরকার চালায়ও তারা। গত একবছরের বেশি সময় ধরে করোনা মোকাবেলার মূল কাজটা কিন্তু আমলারাই করছেন। আগে আমরা জানতাম রাজনীতিবিদরা, জনপ্রতিনিধিরা নীতি নির্ধারণ করবেন; আমলারা সেটা বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু এখন সব কাজ আমলারাই করেন। করোনার সব কাজে আমরা আমলাদেরই দেখি। রাজনীতিবিদরা যেন কোয়ারেন্টিনে আছেন। অথচ আগে সব দুর্যোগে রাজনীতিবিদরাই জনগণের পাশে থেকেছেন।
এই ঘটনায় যদি আমলারা না হয়ে রাজনীতিবিদ কেউ পক্ষ হতেন, তাহলে ঘটনাস্থলে বা থানায়ই ঘটনাটি মিটে যেতে পারতো। কারণ রাজনীতিবিদরা জানেন কোন ঘটনার কীরকম প্রভাব পড়বে। কোনটাতে রাজনৈতিক সরকারের লাভ, কোনটাতে ক্ষতি। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা বা ইচ্ছা আমলাদের নেই। তাই তারা তিলকে তাল বানিয়ে দেশে-বিদেশে সরকারে ভাবমূর্তির চৌদ্দটা বাজিয়ে দিল। ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা না দিয়ে দুর্নীতিবাজদের ধরার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো ভূতটা তো সর্ষের ভেতরেই। যারা দুর্নীতিবাজদের ধরবে, তারাই তো দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত।
রোজিনা গ্রেপ্তারের পর সেতুমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম, ভেবেছিলাম সোমবার রাতটা থানায় কাটালেও মঙ্গলবারই রোজিনা জামিন পেয়ে যাবেন। আমি বলছি না, রাজনৈতিক মন্ত্রীরা ফোন করে বিচারককে জামিন দিতে বলবেন। এই মামলায় ন্যায়বিচার হলো প্রথম সুযোগেই জামিন। একজন নারী হিসেবে রোজিনার জামিন দ্রুততম সময়েই হওয়ার কথা। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মঙ্গলবার জামিনের শুনানিই হলো না। তাহলে রাজনৈতিক মন্ত্রীদের এত আশ্বাস কোথায় গেল? এরপর ঠিক হলো বৃহস্পতিবার জামিন শুনানি হবে। সবাই ধরে নিলেন, মঙ্গলবার না হলেও বৃহস্পতিবার জামিন হবেই হবে। বুহস্পতিবার যখন জামিন শুনানি চলছিল, তখনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, 'যে ঘটনা ঘটেছে সেটি খুব দুঃখজনক।
সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ম্যানেজ করা উচিত ছিল। গুটিকতক লোকের জন্য এই বদনামটা হচ্ছে এবং আমি জানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হিসেবে আমাদের এটি ফেস করতে হবে।' পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঠিক বলেছেন। কারণ তিনি জানেন, এই ঘটনায় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কতটা ক্ষুণ্ণ হবে এবং সেটা পুনরুদ্ধার বা জবাবদিহি করতে তাকে কতটা বেগ পেতে হবে। কিন্তু গুটিকতক আমলার সে দায় নেই, জবাবদিহিতাও নেই। তাই সরকারের রাজনৈতিক মন্ত্রীদের আন্তরিক আশ্বাসের পরও রোজিনাকে এক রাত থানায়, পাঁচ রাত কারাগারে থাকতে হয়েছে। 'গুটিকতক' আমলা বুঝিয়ে দিলেন তাদের হাত অনেক লম্বা, চাইলেই তারা সিন্দুক থেকে একশো বছরের পুরোনো আইন বের করে সাংবাদিকদের শায়েস্তা করতে পারেন, রাজনৈতিক মন্ত্রীদের পাত্তা না দিয়ে, সরকারের ভাবমূর্তির তোয়াক্কা না করে গোয়ারের মত নিজের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে পারেন। আপাতত গুটিকতক আমলাই জিতলেন। কিন্তু আসলে কে জিতলেন?
Advertisement
দলীয়করণ করতে করতে অনেক আগেই আমলাতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি আমরা। এখন সেখানে ঢুকেছে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি। নিয়োগ থেকে শুরু করে পদে পদে অনিয়ম। আর সর্বশেষ নির্বাচনের পর আমলারাই সর্বেসর্বা। তবে দেশের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা দরকার। আমরা চাই যার যার কাজটা সে সে করুক। দেশ চালাকে সৎ ও মানবিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আর তাদের নির্দেশ জনগণের কাছে পৌঁছে দেবে জনমুখী আমলাতন্ত্র। আমরা কেউই যেন নিজেদের প্রভু মনে না করি।
এইচআর/জেআইএম