প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
Advertisement
টিকা বেঁচে সদ্য বিলিওনিয়ার হওয়া নয় ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। করোনা থেকে মুক্তিলাভের জন্য এত সতর্কতার পরও তার নিত্যনতুন ভেরিয়েন্টের আক্রমণ সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা দেয়ার পাশাপাশি সবার জীবন রক্ষার জন্য টিকার প্রয়োজন সবাই অনুভব করছেন। বিশ্বব্যাপী টিকার এত চাহিদা থাকায় এর আর্থিক মূল্য বেড়ে গেছে। পাশাপাশি সহজে টিকাপ্রাপ্তি দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সুযোগ বুঝে ধড়িবাজ কিছু মানুষ কৌশলে টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। টিকা এখন মহামূল্যবান বাণিজ্য পণ্য। তাহলে টিকা নিয়ে রাজনৈতিক ডামাডোল কেন হবে না?
করোনার করাল গ্রাসে সারা বিশ্বে যখন মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন টিকা নিয়ে ফন্দি-ফিকির মানব সভ্যতাকে আরো নতুন করে সংকটে নিপতিত করে ফেলেছে। করোনার তোড়ে এখন কেউ মরে যাচ্ছে, কেউ মেরে ফেলছে। কেউ মাটিতে, কেউ বাতাসে আবার কেউ নদীর পানিতে মিশে জলজ প্রাণির আহারে পরিণত হচ্ছে। এটাই সভ্যতার ধ্বজাধারী সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের সবিশেষ নিয়তি। এই কঠিন সময়ে আবার একে পুঁজি করে এখন কেউ কেউ ব্যবসায় নেমেছে। যা সত্যিই খুব দুঃখজনক ব্যাপার।
সে জন্য সুবিধাপ্রাপ্ত কোন কোন উন্নত দেশে বাচ্চাদেরকে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে অথচ কোন কোন দেশে বয়স্করা টিকার নাগাল পাচ্ছেন না। মানুষ কোথাও টিকা নিতে গিয়ে না পেয়ে ফেরত আসছে আবার কোথাও প্রণোদনা দেয়ার পরও মানুষ টিকা নিতে আগ্রহী নন। থাইল্যান্ডে ‘টিকা নিলে গরু পুরস্কার’ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশটির চিয়াংমাই প্রদেশের মায়ে শায়েম জেলার গ্রামীণ মানুষ গুজব ও কুসংস্কারের ভয়ে টিকা নিতে আগ্রহী না হওয়ায় এই নতুন প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে জেলা কর্তৃপক্ষ। তারা টিকা নিলে দশ হাজার বাথ (সাতাশ হাজার বাংলাদেশী মুদ্রা সমমান) অথবা গরু প্রদানের ঘোষণা দেয়ায় টিকা গ্রহণের ব্যাপারে জনগণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
Advertisement
একে তো করোনার আগ্রাসন তার ওপর জীবন নির্বাহের জন্য একমাত্র জীবিকা হারিয়ে কোটি মানুষ এখন সর্বস্বান্ত। দিনে আনে দিনে খায় মানুষেরা চরম হতাশার মধ্যে নিপতিত। যেখানে তাদের নিত্যদিনের আহার জোটানোর সামর্থ্য নেই সেখানে করোনা আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করবে কি দিয়ে? এছাড়া চিকিৎসা সুবিধাহীনতা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতিটি মুহূর্তে। এই অবস্থায় জীবন রক্ষাকারী টিকা উৎপাদনের সাথে জড়িত কিছু লোভী মানুষ নয়া উল্লাসে মেতে উঠেছে।
টিকা নিয়ে তাদের শেয়ার ব্যবসা ফুলে উঠেছে। টিকা উৎপাদক ধনী দেশগুলো তাদের টিকাস্বত্ব ব্যবস্থা কুক্ষিগত করে রাখায় দরিদ্র দেশের মানুষ নিজেরা টিকা উৎপাদনে যেতে পারছে না। পাশাপাশি টিকা অনুৎপাদক অথচ অন্যান্য ধনী দেশগুলো বেশি দাম দিয়ে টিকা কিনে নিয়ে নিজেদের জনগণের নিরাপত্তায় দ্রুত ব্যবহার করেছে। এভাবে পৃথিবীতে আয় বৈষম্য থেকে টিকা প্রাপ্তির বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যা মানবতাকে উপহাস করছে! তাহলে দুনিয়ার দরিদ্র মানুষেরা কি টিকার নাগাল পেতে গিয়ে ধুলোয় মিশে যাবে?
আমাদের মত দেশ আগাম টাকা পরিশোধ করেও টিকার নাগাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আগাম চুক্তি করে মূল্য পরিশোধ করেও টিকা পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়– করোনার ক্রান্তিকালে তা বিশেষভাবে মানুষের মাঝে দাগ কেটে চলেছে। কথায় বলে- ‘অসময়ে হায় হায় কেউ কারো নয়’। এই দুঃসময়ে ভালুক আর কপট বন্ধুর কথা স্মরণ করে আর কি লাভ? বরং ‘চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা’- এটাই যেন এই দুঃসময়ের কঠিন বাস্তবতা।
দরিদ্র বিশ্বের মানুষের জন্য করোনার তাণ্ডবের চেয়ে টিকা অপ্রাপ্তি এখন বড় হুমকি বলে মনে হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রথম ডোজ গ্রহণের পর টিকা সংকটে থমকে গেছে টিকাদান কার্যক্রম। এই সংকটের ফলে ১৪ লক্ষ মানুষ দ্বিতীয় ডোজের টিকা গ্রহণ করতে না পেরে উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এজন্য উদ্যমী মানুষের মন থমকে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে মনের সাহস। কর্তৃপ্ক্ষ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলে সাধারণ মানুষের মনোবল কিভাবে অটুট থাকবে? আমরা আশা করি বিকল্প ব্যবস্থায় দ্রুত এই জটিল সমস্যার মেঘ কেটে যাক।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি মিটিং করে টিকা বর্তমান উৎপাদকদের নিকট থেকে একক মেধাস্বত্ব প্রত্যাহার করারা ব্যবস্থা নিক এবং বিনাশর্তে প্রচলিত ফর্মুলা ব্যবহার করে সহজে টিকা উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সক্ষম সব দেশের জন্য জানালা খুলে দিক। তাহলে করোনা টিকার অপ্রাপ্তি নিয়ে বিশ্ব থেকে হতাশা কমে যাবে।
এ ছাড়া জাতিসংঘ কর্তৃক তৈরি কৃত টিকার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আশু ব্যবস্থা নেয়া হোক। টিকা বিক্রি করে যারা ইতোমধ্যে বিলিওনিয়ার সেজে মানবতাকে উপহাস করছেন তাদেরকে মানুষের কল্যাণে দ্রুত উদার হবার জন্য ঘোষণা দিয়ে জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসার জন্য আবেদন করি সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এজন্য সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। কারণ এভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে টিকা বিক্রির টাকা দিয়ে দ্রুত ধনী হবার লিপ্সা তো বিশ্ব থেকে দরিদ্রদেরকে অমানবিকভাবে দ্রুত নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার শামিল। আমরা জানি শঠ, অর্থলোভীদের আক্কেল দাঁত গজাতে বেশ কষ্ট হয়, বেশি সময় লাগে।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।
এইচআর/জেআইএম