রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য (উপাচার্য) পদে যাকেই দায়িত্ব দেয়া হয়, তিনিই জড়িয়ে যান বিতর্কে। সবশেষ উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান বিদায় নিয়েছেন অজস্র দুর্নীতি, অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ মাথায় নিয়ে।
Advertisement
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাবিতে উপাচার্য পদে নিয়োগের গোড়াতেই থাকছে গলদ। সিনেটে নির্বাচিত না হয়ে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পেয়ে উপাচার্যরা ক্ষমতার অপব্যহারের সুযোগ পান। হয় দুর্নীতি, পদে পদে অনিয়ম। কারণ তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কারও কাছে জবাবদিহি করা প্রয়োজন মনে করেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন যথাযথভাবে পালন হচ্ছে না বলেই বারবার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, দেশের অন্যতম সেরা এ বিদ্যাপীঠে নিয়োগে অস্বচ্ছতা শুরু হয় ২০০৫ সালের দিকে। ওই সময়ে দায়িত্ব পালন করা বিএনপি সমর্থিত উপাচার্য অধ্যাপক ফাইসুল ইসলাম ফারুকী ৫৪৪ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে বিতর্কের জন্ম দেন। সর্বশেষ উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহানও বিদায়ের আগে ১৩৭ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে যান। যেটি অবৈধ ঘোষণা করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর আগে, ২০০৯-২০১৩ মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে বিজ্ঞাপনে দেয়া পদের বিপরীতে কয়েকগুণ বেশি জনবল নিয়োগ দিয়ে বিতর্ক শুরু করেন ড. সোবহান।
জানা যায়, সর্বশেষ সিনেট প্যানেলের উপাচার্য ছিলেন ১৯৯৮ সালে নিয়োগ পাওয়া অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান খান। এরপর থেকে সিনেটের বাইরে গিয়ে উপাচার্য নিয়োগ শুরু হয় অধ্যাপক ফাইসুল ইসলাম ফারুকীকে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে।
Advertisement
শিক্ষকরা বলছেন, উপাচার্যদের দুর্নীতি আর অনিয়মের শুরু হয়েছে সিনেট ব্যতিরেকে এ পদে নিয়োগের পর থেকে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ বলেন, ‘উপাচার্য নিয়োগের যে সঠিক পন্থা সেটির দীর্ঘদিন থেকে চর্চা নেই। সেক্ষেত্রে যারা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন তারা বিভিন্ন জনের ‘পছন্দের ব্যক্তি’ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এ কারণে দুটো ক্ষতি হচ্ছে। প্রথমত, এভাবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা কম দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, একাডেমিক উন্নয়ন বাদ দিয়ে দায়বদ্ধতা দেখাচ্ছেন যাদের পছন্দে নিয়োগ পেয়েছেন তাদের প্রতি।’
অজস্র দুর্নীতি, অনিয়ম ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ মাথায় নিয়ে সম্প্রতি বিদায় নিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম আব্দুস সোবহান
তিনি আরও বলেন, ‘নিয়োগে সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। একইসঙ্গে জবাবদিহির জায়গা একেবারেই শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশের ভায়োলেশন করে যখন থেকে নিয়োগ শুরু, তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।’
Advertisement
বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক ও সিনেট সদস্য ড. ইফতিখারুল আলম মাসউদ বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে দায়বদ্ধতা দেখান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাদের আচরণও রাজনৈতিক নেতাদের মতো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও যে একজন শিক্ষক, সে অনুভূতিটা ধীরে ধীরে কমছে।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ পাওয়া সর্বশেষ উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহানের ক্ষমতার অপব্যবহারে ১৩৭ জনকে নিয়োগ তার একটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে জবাবদিহি কমেছে বলেই দুর্নীতি বেড়েছে। রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা উপাচার্য পদের মান-মর্যাদা নষ্ট করেছেন। দুর্নীতির রেকর্ড ভঙ্গ করেছেন সর্বশেষ উপাচার্য।’
মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সিনেট সদস্য এনামুল হক বলেন, ‘আইন মেনে নিয়োগ না হওয়ায় উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার যে বডিগুলো আছে, সেখানে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন না। এ কারণেই উপাচার্যরা বেপরোয়া হয়ে যান। কাউকে পরোয়া না করে সবাইকে অন্ধকারে রেখে অনিয়ম করতে থাকেন।’
তাই সিনেট কার্যকরের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ দিতে সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে অনুরোধ জানান তিনি।
উল্লেখ্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ২২ বছরে ছয় জন উপাচার্য সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত না হয়েই দায়িত্ব পালন করেছেন। যাদের অধিকাংশই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে গত ৬ মে উপাচার্য অধ্যাপক এম আব্দুস সোবহান মেয়াদ শেষ করেন। ওই দিনই উপাচার্যের রুটিন দায়িত্ব দেয়া হয় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনন্দ কুমার সাহাকে। এখনো রুটিন উপাচার্য নিয়েই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়টি।
সালমান শাকিল/এমএইচআর/এইচএ/এমকেএইচ