দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে পুরুষের পাশাপাশি বড় ভূমিকা রাখছেন নারীরা। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। গ্রামীণ অর্থনীতিতেও তাদের পথচলা আগের তুলনায় অনেক বেশি সমৃদ্ধ হয়েছে।
Advertisement
গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে ‘উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প’। এই প্রকল্পের মাধ্যমে মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে হাঁস, মুরগি ও ভেড়া পাচ্ছেন নারীরা। আর সেই স্বল্প পুঁজি নিয়েই পুরুষদের পাশাপাশি নিজেদের উদ্যোক্তা হিসবে প্রতিষ্ঠিত করছেন উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা।
জানা গেছে, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরভুক্ত ‘উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প’ বাংলাদেশের উপকূলীয় চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ তৈরি করেছে। প্রকল্পটি বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৬টি উপকূলীয় উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়নে ৫০০ জন করে মোট ৩৪ হাজার সুফলভোগী রয়েছেন। প্রত্যেক সুফলভোগী শুরুতে তিনদিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০টি করে হাঁস বা ২০টি করে মুরগি বা তিনটি করে ভেড়া বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। পাশাপাশি বিনামূল্যে হাঁস, মুরগি ও ভেড়া রাখার জন্য শেড, খাদ্য, ওষুধ, ভ্যাকসিন ও চিকিৎসা সুবিধা পান।
এই প্রকল্পের ৩৪ হাজার সুফলভোগীর ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৩০ হাজার ৬০০ জনই নারী। তারা ঘরে বসে হাঁস, মুরগি ও ভেড়া পালন করে পরিবারের সহায়তা করছেন, একইসঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা পালন করছেন। নারীর ক্ষমতায়ন, চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের বেকারত্ব মোচন ও গুণগত পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে মেধাবী জনগোষ্ঠী গঠনে প্রকল্পটি ভূমিকা রাখছে।
Advertisement
প্রকল্পভুক্ত এলাকাসমূহের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সুফলভোগীদের মাধ্যমে জানা গেছে, অনেকেই ইতোমধ্যে মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২০টি করে হাঁস বা ২০টি করে মুরগি বা তিনটি করে ভেড়া এবং সেগুলো রাখার জন্য শেড, খাদ্য, ওষুধ ও ভ্যাকসিন পেয়েছেন।
নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ধানসিড়ি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নবগ্রামের সুফলভোগী শামসুন্নাহার বেগম বলেন, আমরা তিনদিনের ট্রেনিং শেষে ২০টি মুরগি পেয়েছিলাম, সেখান থেকে এখন মুরগির সংখ্যা ১২০টি। মুরগি থেকে প্রায় ৬০০টি ডিম বিক্রি করেছি।
একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জগদানন্দ গ্রামের সুফলভোগী মর্জিনা বেগম বলেন, আমি তিনদিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সেখান থেকে তিনটি ভেড়া, শেড, খাবার, মেডিসিন আর ভ্যাকসিন বিনামূল্যে পেয়েছি। এখন আমার ভেড়ার সংখ্যা সাতটি।
বরগুনা সদর উপজেলার মুরগি পালন গ্রুপের সুফলভোগী মোসা. মনিকা জানান, তিনি এই প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত ২০টি মুরগি থেকে গড়ে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩টি ডিম পান, এ পর্যন্ত প্রায় ৫০টি বাচ্চা উৎপাদন করেছেন। তিনি প্রায় ৮ হাজার টাকা পুঁজি গড়েছেন।
Advertisement
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ছিল প্রায় ১ দশমিক ৫৩ ভাগ। কিন্তু কোভিড ১৯ পরিস্থিতিতে অন্যান্য খাতের মতো এ শিল্পটিও কিছুটা হোঁচট খেয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯ অনুসারে বাংলাদেশের বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ১৯ শতাংশ। কোভিড ১৯ প্রাদুর্ভাবকালীন দেশে প্রায় ৫৩ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন মানুষ বেকার হয়েছেন যাদের প্রতিদিনের আয় মাত্র ১৬০ টাকা বা ১ দশমিক ৯ ডলার। গত মার্চ থেকে মে পর্যন্ত গড় পারিবারিক আয় কমেছে প্রায় ৭৪ শতাংশ। এ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, টার্কি, ভেড়া, কবুতর পালন বেকার জনসম্পদকে আলোর পথ দেখাতে পারে।
বাংলাদেশে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন মাংস দরকার ১২০ গ্রাম, দুধ দরকার ২৫০ মিলি। এমন প্রেক্ষাপটে দুধ, ডিম তথা পুষ্টির চাহিদা পূরণ, বেকারত্ব মোচন ও উপকূলীয় চরাঞ্চলের অবহেলিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ‘উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প’টি ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
উপকূলীয় চরাঞ্চলে সমন্বিত প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ডা. এস. এম. জিয়াউল হক রাহাত জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত অংশ, বিশেষ করে উপকূলীয় চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে অর্থনীতির মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। এ প্রকল্পটি সরাসরি উপকূলীয় চরাঞ্চলের মানুষকে প্রশিক্ষণ ও বিনামূল্যে ২০টি করে হাঁস বা ২০টি করে মুরগি বা তিনটি ভেড়া এবং হাঁস, মুরগি ও ভেড়া রাখার জন্য শেড, খাদ্য, মেডিসিন ও ভ্যাকসিন বিতরণ করে সাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সুফলভোগীরা এই প্রকল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে প্রকল্প এলাকা বৃদ্ধির জন্য দাবি জানিয়েছেন।
আইএইচআর/এমআরআর/এমএস