বছরের অপেক্ষা কাটিয়ে ব্যাপক উৎসাহে গেল ২৭ নভেম্বর শুরু হয়েছিলো শাস্ত্রীং সংগীতের ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৫’। আর বাঁশির জাদুকর হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার সুরের মূর্ছনা নিয়ে সেটি শেষ হলো মঙ্গলবার দিবাগত রাতে। পাঁচ দিনব্যাপি এই আসরে মঞ্চে এসেছেন প্রায় দুইশ জন সংগীত ও নৃত্যশিল্পী। তারা প্রত্যেকেই ছড়িয়ে গিয়েছেন সংগীতের অমৃতধারা। তবে শেষদিনের মূল আকর্ষণ ছিলেন হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া। তার ডাকাতিয়া বাঁশির সুর শুনতে সেদিন হাজির হয়েছিলেন হাজার হাজার শ্রোতা। শিল্পীও সম্মোহনী সুরে মাতিয়ে গেলেন সৃর পিয়াসীর হৃদয়। মঞ্চে উঠে অবশ্য বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার আগে চৌরাসিয়ার মুখে ঝড়ল বাংলাদেশের প্রশংসা। বললেন, ‘বাংলাদেশ বাঁশির দেশ। আমি চাই এখানে প্রত্যেকের হাতেই বাঁশি থাকবে। বেঙ্গল থেকে আমাকে বলা হয়েছে ওনাদের স্কুলে সময় দিতে, আমি একটু সময় চেয়েছি। ফেব্রুয়ারিতে আবার আসব। যারা যারা শিখতে চান, আমি সহযোগিতা করব।’চৌরাসিয়া আসবেন বাঁশি শেখাতে, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী তার অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শেখাবেন, এ দেশের শিক্ষার্থীদের এসব যেন বাড়তি পাওনা হয়ে রইল এই উৎসবে। মঙ্গলবার উৎসবের শেষ দিন ছিল দর্শনার্থীদের উপচে-পড়া ভিড়। চৌরাসিয়া বাঁশিতে রাগ কিরওয়ানি বাজিয়ে শোনান। এরপর রাগ জৈত রূপক ও তিনতালে বাজান। এরপর তিনি ভাটিয়ালি ধুন বাজিয়ে তার পরিবেশনা শেষ করেন। তানপুরাতে ছিলেন পুষ্পাঞ্জলি। তবলায় সহযোগিতা করেন শুভঙ্কর ব্যানার্জী, পাখওয়াজে পণ্ডিত ভবানী শংকর। পণ্ডিত হরিপ্রসাদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।তবে শেষদিনটি শুরু করেন অনিমেষ বিজয় চৌধুরী ও তার দল। দেশ রাগে ধামার ও রাগ ভূপালিতে চতুরঙ্গ পরিবেশন করে সিলেটের দল গীতবিতান বাংলাদেশ। অনিমেষের সঙ্গে সহশিল্পী হিসেবে ছিলেন কুমকুম ভৌমিক, নূর-ই-আফরোজ, পরেশ চন্দ্র পাল, রুমা চন্দ, শাগুফতা হক, সুব্রত মিত্র, সোনিয়া রায়। শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। এরপর আলারমেল ভাল্লি পরিবেশন করেন ভরতনাট্যম। তিনি রতি সুখ-সারি, উন্নুনীর ভিক্কিনান ও মুত্তাভাদ্দুরা পরিবেশন করেন। আভোগী রাগে নৃত্যলহরী পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আলারমেল ভাল্লি শেষ করেন তার পরিবেশনা। শিল্পীদের হাতে উৎসব স্মারক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী।এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসবের সমাপনী ঘোষণা করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক, ভারতের রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান ড. সৈয়দ এ সামাদ, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ, শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস ড. আনিসুজ্জামান ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের।বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘গত বছর সমাপনী দিনে ৫৬ হাজার দর্শক-শ্রোতা এখানে উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। এদের মধ্যে তরুণ শ্রোতার সংখ্যা ছিল বেশি। এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেক ভাল কিছু করবে।’মেয়র আনিসুল হক বলেন, ‘কেবল অন্ধকার ও হতাশার কথা বললেই হয় না, একটি আলো অন্তত জ্বালাতে হয়। এ কাজটি করছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এত সুন্দরভাবে হাজার হাজার মানুষের এভাবে গান শোনার নজির নেই।’ড. গওহর রিজভী বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘কাল থেকে আবার দিন গণনা শুরু হবে পরবর্তী উৎসবের প্রতীক্ষায়।’ পঙ্কজ শরণ শ্রোতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসবের এ সাফল্য নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণে সাহায্য করবে।’ফজলে হাসান আবেদ বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছে।’ড. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘যে কোনো সুকুমার শিল্পের চর্চা মানুষের মনকে ভাল রাখে। পঞ্চাশ হাজারের বেশী শ্রোতা উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শুনছে- এটা অসামান্য ঘটনা।’বক্তব্য শেষে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের অতিথিদের হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন।সমাপনী অনুষ্ঠানের পর ওস্তাদ ইরশাদ খান পরিবেশন করেন সুরবাহার। রাগ দরবারি কানাড়াতে আলাপ, জোড় আলাপ, ঝালা এবং গৎ বাজিয়ে শোনান তিনি। এরপর পিলু রাগে ঠুমরী বাজিয়ে শেষ করেন তার পরিবেশনা। শিল্পীকে তবলায় সহযোগিতা করেন পণ্ডিত যোগেশ শামসী। খানিক বিরতির পর মঞ্চে আসেন সামিহান কশলকর। তিনি গেয়ে শোনান রাগ যোগ এবং মিশ্র চারুকেশী রাগে দাদরা। পরবর্তী পরিবেশনা ছিল ওস্তাদ সুজাত খানের। তিনি রাগ রাগেশ্রীতে আলাপ জোড় ঝালা এবং আমির খসরুর কম্পোজিশনে গজল পরিবেশন করেন। এরপর মঞ্চে আসেন ওস্তাদ রশিদ খান, যার কথা না বললেই নয়। তিনি খেয়ালের জাদুতে মুগ্ধ করেন অগণিত শ্রোতাকে। রাগ যোগকোশ পরিবেশন করেন। বিখ্যাত গান ‘নায়না আপনি পিয়া সে লাগায় রে’ এবং বিখ্যাত ঠুমরি রাগ ভিন্ন ষড়জে ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গেয়ে শোনান। ওস্তাদ রশিদ খানকে উৎসব স্মারক প্রদান করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রসঙ্গত, গত তিন বছর ধরে আয়োজিত বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব শিল্পী ও দর্শকদের অংশগ্রহণের নিরিখে এরই মধ্যে এই উপমহাদেশের তথা বিশ্বের সর্বাধিক বড় পরিসরের উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার অংশ নিয়েছেন আয়োজনে। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয়েছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীকে। এলএ
Advertisement