মতামত

সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঔপনিবেশিক আইন!

লাভা মাহমুদা

Advertisement

প্রায় ১০০ বছর আগে সামাজিক-রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বৃটিশরাজ কর্তৃক প্রণীত 'অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট' মূলত একটি ঔপনিবেশিক আইন। সে সময় ব্রিটিশদের প্রশাসনে কর্মরত ভারতীয়দের প্রতি এক ধরনের অবিশ্বাস থেকেই এই আইনের জন্ম। দেশের প্রতি মমত্ববোধ থেকেই স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের বিভিন্ন গোপন নথিপত্র সরবরাহ করতেন বৃটিশদের অধীনে কর্মরত ভারতীয়রা। এমনটা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে তথা নিজেদের ঔপনিবেশ টিকিয়ে রাখার একটা কৌশল হিসেবে এই মন্দ আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল।

১৮৯২ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত লর্ড কার্জন যখন ভারতবর্ষের ভাইসরয় ছিলেন তখন এই আইন প্রণয়ন করা হয়। পরে বেশ কয়েক দফা সংশোধিত হয়ে ১৯২৩ সালের ২ এপ্রিল 'অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট' জারি করা হয়। এই আইনটির দু'টি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে গুপ্তচরবৃত্তি এবং অপরটি হচ্ছে সরকারের গোপন নথি ফাঁস।

আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং স্বার্থের পরিপন্থী কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করে তাহলে তার শাস্তি হবে। অর্থাৎ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ কোনো এলাকায় গমন করে, পরিদর্শন করে বা ভেতরে প্রবেশ করে তাহলে শাস্তি হবে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কিত।

Advertisement

এই অ্যাক্ট অনুযায়ী গোপন নথি বলতে বোঝানো হয়েছে অফিশিয়াল কোড, পাসওয়ার্ড, স্কেচ, নকশা, প্ল্যান, বিভিন্ন ধরনের নথি। শত্রুপক্ষের ব্যবহারের জন্য কোনো ব্যক্তি যদি এগুলো সংগ্রহ বা রেকর্ড করে তাহলে এটি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই আইনে বলা হয়েছে, তথ্য পাচার এবং তথ্য গ্রহণকারী-উভয়পক্ষ এর ফলে দণ্ডিত হতে পারেন। এই আইনের অধীনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর পর্যন্ত সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সচিবালয় কোনো নিষিদ্ধ জায়গা নয়। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকারের জন্য সরকার পরিচয়পত্র দিয়েছে এবং সরকার জানে যে সেখানে সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহের জন্য যাবে।

আইনজীবী এবং সাংবাদিকরা বলছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কজনকভাবে প্রথম কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ হলো। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার বৈশিষ্ট্যই হলো গোপনে তথ্য সংগ্রহ করা। এটা তার অধিকার। অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অথচ রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যে মামলা করেছে, তাতে ব্রিটিশ আমলের অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের দুটি ধারা যুক্ত করা হয়েছে।

রোজিনার বিরুদ্ধ অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি এক কর্মকর্তার কক্ষ থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয়’ সরকারি নথি চুরির চেষ্টা করেন এবং মোবাইলেও ছবি তোলেন। যদিও রোজিনা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ‘গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় তথ্য কেন যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি, কারা দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছে– সে বিষয়টি বরং সামনে আসা উচিত। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক যেকোনো উপায়ে তথ্য সংগ্রহের অধিকার রাখেন। সহকর্মীরা দাবি করছেন, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি নিয়ে আলোচিত কিছু প্রতিবেদনের জন্য তিনি আক্রোশের শিকার হয়েছেন। তিনি গুপ্তচরবৃত্তি করেননি এবং কোনো শত্রু রাষ্ট্রের কাছে তথ্য পাচার করেছেন, তার কোনো প্রমাণও নেই। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের দুর্নীতি-অপকর্ম আড়াল করার জন্যই রোজিনা ইসলামকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য ক্ষতির মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

একজন সাংবাদিককে এই আইনে আসামি করে মামলা দেওয়ার পর দেশের স্বাধীন বা মুক্ত গণমাধ্যম নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত আইনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রোজিনা ইসলামকে যেমন মুক্তি দিতে হবে, তেমনি শত বছরের পুরনো আইন বাতিল বা সংশোধনের বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।তথ্য জানার অধিকার দেশের মানুষকে তথ্য অধিকার আইনই দিয়েছে। ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিশেষের অপকীর্তি আড়াল করার জন্য নাগরিকদের জানার অধিকার হরণ করা যায় না, যাবে না।

Advertisement

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

এইচআর/জিকেএস