বিশেষ প্রতিবেদন

চট্টগ্রামে ৭৬ আদালতে ঝুলছে ২ লাখ ১০ হাজার মামলা

চট্টগ্রাম আদালতে ৭৬টি বিচারিক আদালতে ঝুলছে প্রায় ২ লাখ ১০ হাজার মামলা। মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতির কারণে দিন দিন বাড়ছে জট। মামলা কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হওয়ায় বিচার প্রার্থীরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া পারিবারিক আদালতে দু’যুগ ধরে নেই বিচারক। মামলা নিষ্পত্তিতে ধীর গতিই মামলার জটের মূল কারণ বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের আইনজীবীরা। এতে করে ভোগান্তি বাড়ছে বিচার প্রার্থীদের। আইনজীবীদের মতে, বিচারক সংকট, বিচারিক আদালতের স্বল্পতা, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ, অহেতুক সময়ের আবেদন, সঠিক সময়ে সাক্ষী হাজির না হওয়া, আসামিপক্ষের অহেতুক সময়ের আবেদনসহ নানা কারণে বাড়ছে এসব মামলার জট। এদিকে, ফৌজদারি মামলার বিচার কার্যক্রম দীর্ঘসূত্রতার কারণে নষ্ট হচ্ছে অনেক মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত। অপরদিকে, চট্টগ্রামের অধিকাংশ আদালতে ব্যাপক আকারে মামলার জট লেগে থাকলেও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল, পরিবেশ আদালতসহ কয়েকটি আদালতে চলছে মামলার খরা।চট্টগ্রাম জেলা ও দায়রা জজ আদালত, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, পরিবেশ আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনালসহ চট্টগ্রামের ৭৬টি আদালতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার। তার ওপর প্রতিদিনই দায়ের হচ্ছে নতুন নতুন  মামলা। এর মধ্যে জেলা ও দায়রা জজের আওতাধীন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মিলে ১ লাখ ১৭ হাজার। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে রয়েছে সাড়ে ২৩ হাজার মামলা। একইভাবে সিএমএম আদালতের অধীনস্থ আদালতগুলোতে মামলা রয়েছে ২৬ হাজার। মহানগর দায়রা জজ আদালতের অধীনস্থ আদালতগুলোতে মামলা রয়েছে ২২ হাজার। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৩টিতে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১৫ হাজার।পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে প্রায় ২৬৬টি, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা রয়েছে ১৫০টি। চট্টগ্রাম আদালতে মামলার সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি আদালত বা বিচারকের সংখ্যা। এর ফলে বিচারকার্য বিলম্বিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম দেওয়ানি আদালতে এমন কিছু মামলা রয়েছে যেগুলো দীর্ঘ ২০ থেকে ২৫ বছরেও শেষ করা যাচ্ছে না। অপরদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া মামলা ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পন্ন করার কথা থাকলেও কোনো কোনো মামলা বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। একই অবস্থা অন্য আদালতগুলোতেও। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মামলার জট। অন্যদিকে বিচারাধীন মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির হতে সমন বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সময়মতো তা কার্যকর করছে না। আবার সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া না গেলে তার প্রতিবেদন আদালতে পৌঁছাতেও দুই থেকে তিন কার্যদিবস পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ করছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। ফলে মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হচ্ছে। বিচারক সংকটের কারণে শূন্য পদে অন্য বিচারকরা অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বিচারপ্রার্থীদেরও বছরের পর বছর ধরনা দিতে হয় আদালত প্রাঙ্গণে। আদালত সূত্র জানায়, দীর্ঘ দুই বছর ধরে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের পদটি শূন্য রয়েছে। এছাড়া বিভাগীয় স্পেশাল জজ আদালত ও বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারকের পদটিও বেশ কটি আদালতে বিচারকের পদ শূন্য রয়েছে। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনামুল হক বলেন, সরকারের নজরদারি না থাকায় চট্টগ্রাম আদালতে মামলার হার বাড়লেও বাড়েনি বিচারিক আদালত। যেসব বিচারকের পদ রয়েছে তার মধ্যে অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালসহ বেশকিছু পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। যার কারণে ওইসব আদালতে বিচার কার্যক্রম স্থিমিত হয়ে পড়েছে।এদিকে চট্টগ্রামের দুটি পারিবারিক আদালতের একটিতেও নিজস্ব বিচারক নেই। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ভারপ্রাপ্ত জজ দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে মোহরানা, খোরপোষ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, বিবাহ বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজতসহ পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত স্পর্শকাতর মামলাগুলোর বিচারকাজ। মামলা দায়েরের ৬ মাসের মধ্যে শুনানি ও এক সপ্তাহের মধ্যে রায় ঘোষণার নিয়ম থাকলেও বিচারক না থাকায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরেও বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। বর্তমানে চট্টগ্রামের পারিবারিক আদালত দুটিতে ২ হাজার ২৭৭টি নিয়মিত মামলা, ৬০টি আপিল, জারি ও রিভিউ পিটিশন মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার মামলার জট রয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিচারালয়ের বিচারব্যবস্থার এই বেহাল দশায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে আদালতগুলোতে বিচারক নিয়োগের দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন।আদালত সূত্র জানায়, পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৯৮৫ সালে সারাদেশের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামেও দুটি পৃথক পারিবারিক আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু আদালত প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরেও এসব আদালতে বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি অথচ একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা জেলার একাধিক পৃথক পারিবারিক আদালতে একাধিক বিচারক রয়েছে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিচারালয় হওয়া সত্ত্বেও অন্য আদালতের ওপর অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে ভারপ্রাপ্ত বিচারকের মাধ্যমে গোঁজামিল দিয়ে চালানো হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ এই আদালতের বিচরকাজ। সরেজমিন আদালত ঘুরে দেখা গেছে, প্রথম অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতে বিচারক না থাকায় পারিবারিক আদালতের মামলাগুলো বর্তমানে একেক সময় একেকজন সিনিয়র সহকারী জজ শুনানি করছেন।নিজস্ব আদালতে বিচারক সঙ্কটের কারণে পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রি-ট্রায়াল বা পোস্ট-ট্রায়ালগুলো (বিচারপূর্ব শুনানি) সম্ভব হচ্ছে না। এডিআর বা বিকল্প পদ্ধতিতে বিচার নিষ্পত্তির সুফল না পাওয়া ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের এবং বিচারপ্রার্থীদের বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরতে হচ্ছে অথচ পারিবারিক আদালতের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো মামলা দায়ের হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে শুনানি শেষ করতে হবে এবং শুনানির এক সপ্তাহের মধ্যে রায় প্রদান ও প্রচার করতে হবে অথচ বাস্তবে এসব মামলার শুনানি শেষ হতে ৩ থেকে ৪ বছর লেগে যাচ্ছে। শুনানি শেষে রায় পেতেও লেগে যায় আরও কয়েক মাস। এছাড়া স্পর্শকাতর পারিবারিক বিষয়গুলো সহকারী জজ আদালতগুলোতে বিপুলসংখ্যক বহিরাগত মানুষের সামনে শুনানি হওয়ায় বাদী-বিবাদীকে নানাভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে। এ অবস্থায় বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। হয়রানির ভয়ে অনেকে মামলা পরিচালনা করতেও অনীহা প্রকাশ করছেন।ভুক্তভোগী শারমিন আক্তার জানান, দীর্ঘদিন ধরে স্বামীর সংসারে নিগৃহীত হয়ে ২০১০ সালের জুন মাসের ৬ তারিখে তার স্বামী ও শ্বশুরালয়ের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন। মামলার পর স্বামী সৌকর্ণ তাকে এবং তার ৬ বছরের সন্তানকে ফেলে বিদেশ চলে যান। অভিযুক্ত সৌকর্ণের পক্ষে তার বোন আদালতে হাজিরা দেন। একপর্যায়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রি-ট্রায়াল ও সোলেনামার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তির জন্য কয়েকটি দিন ধার্য করে আদালত।কিন্তু অভিযুক্তের বোনের অসহযোগিতা ও পারিবারিক আদালত দীর্ঘদিন বিচারকশূন্য থাকায় মামলাটি আজও নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে শারমিন চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার কর্মস্থল থেকে এসে মামলা পরিচালনা করছেন। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা পরিচালনার ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন নির্যাতিত শারমিন।বেসরকারি ইউনিভার্সিটি আইইউসিতে অধ্যয়নরত সাবিহা শরীফ পারিবারিক কলহে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়েবিচ্ছেদের পর মোহরানা ও খোরপোষের দাবিতে পারিবারিক আদালতে মামলা করেন গত বছরের আগস্ট মাসে। ওই বছরেই মামলাটির একতরফা শুনানি হয়। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও রায় প্রদান করা হয়নি। সাবিহা বর্তমানে পুনরায় বিবাহিত ও দুগ্ধপোষ্য সন্তানের জননী। ফলে ন্যায়বিচার ও পাওনা নিয়ে আশাহত হচ্ছেন সাবিহা ও তার পরিবার।সম্প্রতি পারিবারিক আদালতের বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধান বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস্ ফাউন্ডেশন। সংস্থাটির চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট জিয়া হবীব আহসান জানান, চট্টগ্রাম জেলা এবং মহানগর নিয়ে ২২টি উপজেলা ও থানা এলাকায় অগণিত বিচারপ্রার্থী নারী-পুরুষ ও শিশুকে মোহরানা, খোরপোষ, অভিভাবকত্ব, বিয়েবিচ্ছেদ ও দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা নিয়ে এসব আদালতের আশ্রয় নিচ্ছেন। পাঁচটি অধিক্ষেত্রসম্পন্ন পারিবারিক আদালতের জন্য অন্তত দুটি পৃথক নিজস্ব পারিবারিক জজ নিয়োগ দিলে ভুক্তভোগীদের বিড়ম্বনা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। এছাড়া পৃথক পারিবারিক আপিল আদালত না থাকায় বিজ্ঞ জেলা ও দায়রা জজ আদালতকে এসব পারিবারিক আপিল মামলাও শুনতে হয়। তিনি চট্টগ্রাম জেলার দেওয়ানি ও ফৌজদারি মোকদ্দমা পরিচালনাসহ বিচার প্রশাসন পরিচালনার পাশাপাশি পারিবারিক আপিল শুনানিতে অংশ নিতে গলদঘর্ম হচ্ছেন।তিনি বলেন, আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধান বিচারপতি, আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় সংসদের প্রতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে অসহায় নারী ও শিশুসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্যের মানবাধিকার সুরক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি।জীবন মুছা/জেডএইচ/পিআর

Advertisement