আন্তর্জাতিক

ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ‘ঐতিহাসিক প্রেম’

ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনায় গত ৪৯ বছরে অন্তত ৫৩বার জাতিসংঘের নিন্দাপ্রস্তাব আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে এবারের সহিংসতার মধ্যেই মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে তিনবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত ইসরায়েল-বিরোধী প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন।

Advertisement

দখলদার ইসরায়েলের প্রতি মার্কিনিদের এমন নগ্ন সমর্থন চলছে বহু বছর ধরেই। তাদের সহযোগিতাতেই নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর যুগের পর যুগ দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে হানাদাররা। জবাবে ফিলিস্তিনিরা কোনো প্রতিবাদ করতে গেলেই সেঁটে দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাসীর তকমা। অথচ ইসরায়েলিরা গুলি করে পাখির মতো মানুষ হত্যা করলেও তাতে কোনো বিকার নেই ওয়াশিংটনের।

এক নজরে দেখে নেয়া যাক যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল-প্রেমের কিছু নমুনা-

গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন১৯৪৮ সালের যুদ্ধে বিতাড়িত ফিলিস্তিনিরা তাদের পুরোনো বাড়িঘরে ফিরতে ২০১৮ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েলি সীমান্তবেঁড়ার কাছে তীব্র আন্দোলন শুরু করেন। জাতিসংঘের হিসাবে, সেই যুদ্ধে সাড়ে সাত লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। ফিলিস্তিনিরা এটিকে ‘নাকবা’ বলে থাকেন।

Advertisement

বছরব্যাপী চলা ওই আন্দোলনে স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি চালায় দখলদার ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এতে অন্তত ২৬৬ জন নিহত হন, আহত হন ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ।

এ ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে ২০১৮ সালের ১ জুন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ (ইউএনএসসি) একটি খসড়া নিন্দাপ্রস্তাব উত্থাপন করে। কিন্তু ইসরায়েল-বিরোধী সেই প্রস্তাবে ভেটো দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন দূত নিকি হ্যালি। তার দাবি, প্রস্তাবটি ছিল একেবারেই একপাক্ষিক। গাজার সেই সহিংসতার জন্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে দায়ী করেন এ মার্কিন প্রতিনিধি।

বেআইনিভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলি রাজধানীর স্বীকৃতিআন্তর্জাতিক চুক্তি অনুসারে পূর্ব জেরুজালেম ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হওয়ার কথা। তবে ১৯৬৭ সাল থেকে এলাকাটি দখল করে রেখেছে ইসরায়েল।

তবে ইউএনএসসির প্রস্তাব ও আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে, অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমকে কোনোভাবেই ইসরায়েলি অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এরপরও ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের একক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

Advertisement

দ্বিতীয় ইন্তিফাদায় ইসরায়েলকে সমর্থনদ্বিতীয় ইন্তিফাদা বা ফিলিস্তিনি উত্থান শুরু হয়েছিল ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। সেদিন ইসরায়েলের তৎকালীন বিরোধী নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে পবিত্র আল-আকসা মসজিদে ঢুকলে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে। ঐতিহাসিক অসলো চুক্তি কার্যকর না হওয়ার হতাশা আরও উসকে দেয় ইসরায়েলি নেতার এই আচরণ।

ফিলিস্তিনি ভূমি দখল বন্ধে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইৎঝাক রবিনের মধ্যে এই চুক্তি সই হয়েছিল। কিন্তু এরপরও ২০০০ সাল অব্দি চলে দখলদারদের আগ্রাসন। ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্ব ধূলায় মিশিয়ে একের পর এক স্থাপনা গড়ে গড়ে তোলে ইসরায়েল।

আশির দশকের শেষ ও নব্বই দশকের শুরুর দিকে হওয়া প্রথম ইন্তিফাদা অনেকটাই শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ইন্তিফাদা হয়ে ওঠে সহিংস। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। চলে ইসরায়েলি স্থাপনায় আত্মঘাতী হামলাও। জবাবে ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষ হত্যা শুরু করে ইসরায়েল।

বিবিসির হিসাবে, ওই সময় তিন হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি ও প্রায় এক হাজার ইসরায়েলি প্রাণ হারান। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ৪৫ বিদেশিও।

বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলার প্রতিবাদ এবং শান্তি আলোচনার আহ্বান জানিয়ে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। কিন্তু স্বভাবতই তাতে ভেটো দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

দখলদারিত্ব বৃদ্ধিআন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি ভূমি দখল সংক্রান্ত অন্তত চারটি নিন্দাপ্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় অন্তত ২৫০টি স্থাপনায় ছয় থেকে সাড়ে সাত লাখ ইসরায়েলি জোরপূর্বক বসত গেঁড়েছে। এই দখলদারিত্ব আরও বেগবান হয় বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসার পর থেকে। তার সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্কও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঘনিষ্ঠ।

দখল সংক্রান্ত ইসরায়েল-বিরোধী প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো দেয়ার শুরু বলা যায় ১৯৮৩ সালে। সবশেষ ২০১১ সালে একই ধরনের সিদ্ধান্ত জানিয়েছে তারা। তৎকালীন মার্কিন দূত সুজান রাইস জাতিসংঘের ওই প্রস্তাবে ভেটো দেন। তিনি ছিলেন ওবামা প্রশাসনের কর্মকর্তা।

বারাক ওবামার প্রশাসনে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জো বাইডেন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তিনিও ইসরায়েল-প্রেমী হিসেবে পরিচিত। তবে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন দিয়ে ডেমোক্র্যাট শিবিরে বেশ তোপের মুখে পড়েছেন এ নেতা। চাপের মুখে গত বুধবার ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দুই পক্ষকেই যুদ্ধবিরতিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

সূত্র: আল জাজিরা

কেএএ/এএসএম