জুয়া খেলার অনলাইন অ্যাপ বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তবে বিশেষ পদ্ধতিতে স্মার্টফোনের মাধ্যমে একটি জুয়ার অ্যাপ ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ওই অ্যাপের ব্যবহার-প্রসারে হাতেগোনা কয়েকজন জড়িত থাকলেও না বুঝে ব্যবহার করছেন লক্ষাধিক বাংলাদেশি। ওই অ্যাপে জুয়া খেলতে প্রয়োজন হয় ডিজিটাল কারেন্সি এবং ‘জেমস’। এর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রতি মাসে বিদেশে পাচার হচ্ছে শত কোটি টাকা। বছরে যার পরিমাণ হাজার কোটিরও বেশি।
Advertisement
বুধবার (১৯ মে) দুপুরে রাজধানীর বারিধারায় পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম (এটিইউ) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান এসব কথা বলেন।
সম্প্রতি নোয়াখালীর সুধারামপুর, ঢাকার সাভার এবং রাজধানীর বনশ্রী এলাকা থেকে চক্রটির চার সদস্যকে গ্রেফতারের পর এসব তথ্য জানতে পারে এটিইউ। গ্রেফতাররা হলেন- জমির উদ্দিন (৩৫), মো. হোসেন রুবেল (৩৯), মনজুরুল ইসলাম হৃদয় (২৬) ও অনামিকা সরকার (২৪)।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম বলেন, গ্রেফতাররা একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অ্যাপ ব্যবহার করে মুদ্রা পাচার করে আসছিল। ওই অ্যাপে গ্রুপ চ্যাট, লিপ সিং, ড্যান্স, গল্প, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন ধরনের অনলাইন জুয়া খেলার অপশন রয়েছে। বাংলাদেশে এই অ্যাপসসহ যেকোনো জুয়া বা অনলাইন প্রতারণা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ।
Advertisement
তিনি বলেন, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে এসব প্রতারণা ও ডিজিটাল মুদ্রা পাচার রোধে গোয়েন্দা নজরদারি, তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। যার অংশ হিসেবে ওই অ্যাপের মাধ্যমে বাংলাদেশে যারা সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে প্রতারণা এবং ডিজিটাল মাধ্যমে মুদ্রা পাচার করছে তাদের চার মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছে এটিইউ।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগের এই অ্যাপটিতে দুই ধরনের আইডি রয়েছে। একটি হচ্ছে ইউজার আইডি এবং হোস্ট আইডি। ব্যবহারকারীরা সাধারণত নারী ও সেলিব্রেটিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে এই অ্যাপটি ব্যবহার করেন। হোস্টরা একটি এজেন্সির মাধ্যমে এই অ্যাপে হোস্টিং করেন। সুন্দরী নারী এবং সেলিব্রেটিরাই সাধারণত এই এজেন্সির মাধ্যমে হোস্ট আইডি খোলেন।
এতে দুই ধরনের এজেন্সি রয়েছে। যার একটির মাধ্যমে বিদেশি এই অ্যাপটির অ্যাডমিনদের কাছ থেকে ‘বিন্স’ কিনে ইউজারদের কাছে বিক্রি করে। এই বিন্সও এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি। এছাড়াও এই অ্যাপসে জেমস নামেও এক ধরনের ডিজিটাল কারেন্সি আছে।
জানা যায়, প্রতি এক লাখ বিন্সের মূল্য এক হাজার ৮০ টাকা এবং প্রতি এক লাখ জেমসের মূল্য ৬০০ টাকা বা তার কম। কিন্তু এক বিন্স সমান এক জেমস। ইউজাররা হোস্টদের গিফট হিসেবে বিন্স প্রদান করেন কিন্তু এই বিন্স হোস্টদের কাছে এলেই তা জেমসে পরিণত হয়। সঞ্চিত জেমসের পরিমাণের ওপরই নির্ভর করে হোস্টদের আয়। তবে হোস্টদের মাস শেষে বেতন পাওয়ার জন্য শুধু সঞ্চিত জেমসই যথেষ্ঠ নয়। তাকে প্রতিদিন এবং প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লাইভ স্ট্রিমিংয়ে থাকতে হয়।
Advertisement
এসপি আসলাম আরও বলেন, এই বিন্স এবং জেমস নামের ডিজিটাল কারেন্সিই আমেরিকান এই অ্যাপের একমাত্র চালিকাশক্তি। দেশীয় বিন্স এজেন্সিগুলো সাব-এজেন্সি নিয়োগসহ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরী মেয়েদের বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন ভাবে লোভনীয় অফার দিয়ে লাইভ স্ট্রিমিংয়ে এনে ইউজারদের সঙ্গে প্রতারণাও করে।
গ্রেফতার প্রতারক চক্রটির চার সদস্য ও তাদের পাঁচ সহযোগীর বিরুদ্ধে সাভার থানায় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
এ ব্যাপারে এটিইউ সাইবার অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের পুলিশ সুপার মো. মাহিদুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে এই অ্যাপসের ১১ জন এজেন্ট রয়েছে। তারাই ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি ক্রয়-বিক্রয় করে। লক্ষাধিক বাংলাদেশি ইউজার বিকাশ, রকেট, নগদসহ বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডি, হাওয়ালা, ক্রিপ্টো কারেন্সি এবং বিদেশি একটি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল বা ভার্চুয়াল কারেন্সি কিনছেন। যার মাধ্যমে প্রতি মাসে শত কোটির বেশি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এই লক্ষাধিক ব্যবহারকারীর অনেকেই জানেন না এটা জুয়া। এর ব্যবহার বা বিন্স, জেমস কিনে দেশের টাকা লেনদেন যে মুদ্রা পাচার কিংবা মানি লন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ সেটাও তারা বোঝেন না।
এটিইউ সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারদের মধ্যে নাটোরের অনামিকা সরকার (২৪) পড়াশোনা করেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে। সেখানে থাকতেই দেশে এই জুয়া খেলার অন্যতম হোতা রোকন উদ্দিন সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়। এরপর তারা পরিবারের অজান্তে বিয়ে করেন। রাজধানীর বনশ্রীতে বাসা ভাড়া নিয়ে তারা এই কাজ করে আসছিলেন। গত দেড় বছরে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক একাউন্টে কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। অনামিকাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলেও অভিযানের খবর পেয়ে পালিয়ে যান তার স্বামী রোকন।
টিটি/এসএস/এএসএম