দেশের ২য় বৃহত্তম নদী মাতৃক ও সীমান্ত ঘেষা জেলা কুড়িগ্রাম। জেলার নয়টি উপজেলা জুড়ে ধুম পড়ছে আমন ধান কাটা, মাড়াই আর বিক্রয়ের মহোৎসব। কৃষাণ-কৃষাণীদের মুখে হাসির বদলে দেখা দিয়েছে হতাশার কালো মেঘ। জমিতে পোকামাকড় আক্রমণ, আশানুরূপ ফলন, আর দাম না পাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন জেলার সাধারণ কৃষকরা।১৬টি নদ-নদী বেষ্টিত সাড়ে চার শতাধিকের মতো চর-দ্বীপ চরের এই জেলার আয়তন ২২৪৫.০৪ বর্গ কিলোমিটার। প্রায় ২১ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। জেলায় দুই লক্ষ ২৪ হাজার ৫শ` ৪ হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে আবাদী এক লক্ষ ৬২ হাজার ২শ` ৮৮ হেক্টর জমি। চরাঞ্চলে ২৯ হাজার ৮শ` ২৪ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদী ২২ হাজার ৫শ` ৪৯ হেক্টর জমি রয়েছে।কুড়িগ্রামে সময়ের বিবর্তনে খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলায় পরিণত হয়ে উঠে অল্প সময়ের মধ্যে। কয়েক বছর ধরে আমন ও বোরো মৌসুমে এই জেলার কৃষকরা লক্ষ্যমাত্রার অধিক ধান উৎপাদন করছেন। কিন্তু চলতি বছরে তিন দফা বন্যায় আমন ফলনে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন এখানকার কৃষক। ফলে সংশয় দেখা দিয়েছে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। বর্তমান বাজার দরের কারণে উৎপাদন খরচ তুলতে হিমশিম খাচ্ছনি কৃষকরা।জেলার সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের প্রতাব গ্রামের কৃষক মোফাজ্জল হোসেন (৫০) জাগো নিউজকে জানান, আমি এবার তিন একর জমিতে আমন ধান আবাদ করেছি। যেখানে গেল বছর প্রতি একরে ২০ হাজার টাকার মতো খরচ করে প্রায় ৫০ মণ ধান পেয়েছিলাম। কিন্তু এবারে সার, তেল, কীটনাশকসহ সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করে ৪৫ মণের বেশি ধান পেয়েছি। বাজারে ধানের দাম ৫শ` থেকে ৫শ` ৫০ টাকা দরে বিক্রি হওয়ায় উৎপাদন তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এবারে একর প্রতি জমিতে ধান চাষ করতে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি একরে ৪০-৪২ মণ ধান পেয়েছি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, এক মণ ধান বিক্রি করে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামের কারণে এখন আর মাছ-মাংস জোটে না। সরকার যদি ডিলার মাধ্যমে ধান ক্রয় না করে মাঠ পর্যায়ের কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয় করে তাহলে আমাদের মতো সাধারণ কৃষকরা ন্যায্য দাম পাওয়ার পাশাপাশি ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারবে। একই গ্রামের কৃষক ইসকেন্দার আলী (৩২) দেড় একরে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ করে ফলন পেয়েছেন ৬৫ মণ ধান। আনোয়ার হোসেন (৩০) দুই একর জমিতে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করে ৮৫ মণ ধান পেলেও মনে শান্তি নেই তার। আমনের ক্ষেতে বিভিন্ন রকমের পোকামাকড় আক্রমণ করায় যথেষ্ট পরিশ্রম করেও ভালো ফলন পাননি। কারেন্ট পোকার আক্রমণ ছিল সবচেয়ে বেশি। ফলে ফলন খুব ভালো হয়নি। তারা জানান, এ বছর আমন ক্ষেতে নিয়ম অনুযায়ী সার বীজ প্রয়োগ করেও প্রচুর কারেন্ট পোকার আক্রমণ ছিল তাই ভালো ফসল হয়নি। ধান গাছ ভালো হলেও ধানে পাতানের সংখ্যা ছিল বেশি। এতো টাকা খরচ করে ধানের দাম না থাকায় বিপদেই আছি। সামনে ধানের দাম না বাড়লে আগামীতে ধান আবাদ করাই বাদ দেয়ার উপক্রম হবে। সরকার প্রতি বছর সরকারিভাবে ধান ক্রয় করলেও সঠিকভাবে সেখানে ধান ক্রয় করা হয় না। নানা অনিয়ম চলে ওখানে। দলীয় প্রভাবে স্লিপ বিতরণ আর পাইকারের কাছ থেকে বাইরে থেকেধোন সংগ্রহ করে গোডাউনে ভরায়। এছাড়াও অনেক ঠিকাদাররা সরকারের ভিজিএফ, ভিজিডির চাল বাজার থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো নিয়ে যায় গোডাউনে। সাধারণ কৃষকরা গোডাউনের কাছে ভীড়তেই পারেন না তাদের উপদ্রবে। তাই আমরা সরকারের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছি। তারা আরও জানান, সরকার যদি ধান ক্রয়ের ব্যবস্থায় পরিবর্তন না আনে তাহলে আমরা কৃষকরা উৎপাদন খরচের কারণে ধান আবাদ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেবো। উলিপুর উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নের সাদুল্ল্যা গ্রামের কৃষক সোয়েব আলী (৫৫) জানান, আড়াই একর জমিতে ধান আবাদ করছি বাহে। এবারকার বন্যায় দুই একর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়া গেইচে। আধা একরের ধান দিয়া কোনোরকমে হামার সংসারের চাহিদা মেটাতিই যাবে। ধান নষ্ট হওয়ার কারণে প্রায় ৩০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। সামনে ক্যাংকা করি ধান আবাদ করবো সেই চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়া গেইছে বাহে।কুড়িগ্রাম খামারবাড়ি সূত্রে জানা যায়, চলতি আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৮ হাজার ৩শ` ৯৬ হেক্টর জমি। এরমধ্যে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে এক লাখ তিন হাজার ২৯১ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়। জেলায় দু’দফা বন্যায় ২০ দিনের বেশি পানি স্থায়ী থাকায় ৪৪ হাজার ৮৫ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর এতে করে আমন আবাদে অর্জিত হয়েছে ৮২ হাজার ৫২ হেক্টর। এতে গত বছরের তুলনায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। গত বছর আমনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ আট হাজার ৩শ` ৭৪ হেক্টর। সেখানে অর্জিত হয়েছে ৮৭ হাজার ৪শ` ২৯ হেক্টর। আর সেবারের বন্যায় ক্ষতি হয়েছিল ৪১ হাজার ২শ` ১৪ হেক্টর আবাদি জমি। খামারবাড়ির উপ-পরিচালক শওকত আলী জাগো নিউজকে জানান, পরপর দু’দফা বন্যার কারণে আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য সরকারি ও কৃষকদের সহযোগিতায় বেশ কিছু এলাকায় ধানের বীজ সরবরাহ করেছি। আমনের ফলনে বন্যার ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণক মো. আশ্রাফুজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, আমন মৌসুমে ধান ক্রয় করা হয় না। চাল সংগ্রহ করা হয়। এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয় থেকে চাল সংগ্রহ করার কোনো চিঠি আসেনি। এদিকে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, সরকার চলতি আমন ধানের মূল্য প্রতি কেজি ৩১ টাকা দর নির্ধারণ করেছে। যা আগামী ১৫ ডিসেম্বর থেকে ক্রয় শুরু করার কথা রয়েছে।এমজেড/পিআর
Advertisement