চুরির তকমা দিয়ে রুমে আটকে রেখে ৫ ঘণ্টা নির্যাতন, দাগি সন্ত্রাসীর মতো আদালতে টানাহেঁচড়া, পুলিশ ভ্যানের লোহার শিকের জানালার ফাঁকে দেখা যাওয়া একজন রোজিনা ইসলাম। ছবি শুধু রোজিনার? না-কি দেশের পুরো গণমাধ্যমের। সমাজ বদলে দিতে দুর্নীতিবাজদের বিষয়ে সরকারি তথ্য চুরির (!!) অপরাধে গণমাধ্যম লালদালানে। আর হাজার কোটি টাকা চুরি করে বিদেশে পাচারকারীদের গাড়ি চলে বিশেষ নিরাপত্তায়। একের পর এক সাংবাদিক কিংবা গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরা কী বার্তা দিচ্ছে? কোন জেদে এই আচরণ? দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার, সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য রোজিনার বিভিন্ন প্রতিবেদনে চলে আসায়?
Advertisement
দুনিয়ার কোন্ দেশে দুর্নীতিবাজরা নিজের দুর্নীতির খবর নিজে দেয় কখনো? অপরাধী স্বেচ্ছায় এসে গণমাধ্যমকে বলে সে অপরাধী? সেই তথ্য সাংবাদিকতার মাধ্যমেই আসে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, সংবাদপত্রহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্র-দুটোর একটা বেছে নিতে হলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেবেন। সচিবালয়ে কোন্ দুঃসাহসে একজন সাংবাদিকের গলা টিপে ধরা যায়? তার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। প্রকারান্তরে তা রাষ্ট্রের সমর্থন এবং আনুকূল্য। এর আগে আরেক নারী কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক পারভীন সুলতানার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করায় সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে পুলিশ অমানসিক নির্যাতন করে। জনপ্রতিনিধিরা সাংবাদিক নির্যাতন করছেন, সরকারের কর্তাব্যক্তিরা করছেন। সুলতানা, জেবুন্নেছারা করছেন। শিক্ষা দিয়ে ছাড়ছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় ভুয়া নাম যুক্ত করা, খুলনার কোন এক মন্ত্রীর ভাইয়ের জমজমাট মাদক ব্যবসাসহ অসংখ্য অনুসন্ধানী চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন করেছেন রোজিনা ইসলাম। কোনো অপরাধী তাকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে যায়নি। এসব তথ্য তাকে তুলে আনতে হয়েছে বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে অথবা চুরি করেই। হতে পারে সেই ধাঁচের কিছুর জন্যই সেদিন তার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছুটে যাওয়া। মন্ত্রী বলেছেন, অতিরিক্ত সচিবকে খামচি ও থাপ্পড় মেরেছেন রোজিনা। সাফাই এভাবে দিতে হয়?
রোজিনার স্বামী মিঠু ক্ষমতাসীন দলের নেতা। তারা সেদিন একসঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন সচিবালয়। দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন নেন তারা। তারপর সচিবালয় থেকে বের হওয়ার আগ মুহূর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে একটি ফোন আসে রোজিনার নাম্বারে। রোজিনা স্বামীকে বিদায় দিয়ে তার সোর্সের কাছে যান। তিনি একটি কাগজ পান। তারপর সে শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য সচিবের রুমে প্রবেশের জন্য পিএসের রুমে যান। পিএস না থাকায় রোজিনা বেরিয়ে যেতে চাইলে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য তাকে বসতে বলেন। রোজিনা বসে একটি পত্রিকা পড়তে থাকায় হঠাৎ ঢোকেন অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা। সঙ্গে একজন নারী ডিএস। তারা রোজিনাকে সমানে গালমন্দ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে গলা চেপে ধরে টেবিলের নিচে ফেলে বুকের ওপড় চেপে বসেন। আরেকজন তার দুই হাত মুচড়ে দেন। বুঝতে বাকি থাকে না নারী দিয়ে নারী শায়েস্তা করার চাবিটা নাড়ানো হয়েছে দক্ষ হাতে। প্রায় ৫ ঘণ্টা নির্যাতনে রোজিনা অজ্ঞান হয়ে পড়লে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পিআরও রোজিনার স্বামী মিঠুকে সচিবালয়ে আসতে বলেন। মিঠু রোজিনাকে অজ্ঞান অবস্থায় টেবিলের পাশে পড়ে থাকতে দেখে। তারা বলে রোজিনাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু হাসপাতালে না নিয়ে ঢোকানো হয় শাহবাগ থানায়।
Advertisement
রোজিনা'র বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্যি হলেও তাকে রাষ্ট্রের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র সচিবালয়ে ৫ ঘণ্টা আটকে রাখা যায় না। অপরাধ করলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই আইনি সহায়তা নিতে পারতো, রোজিনা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারলে শাস্তি পেত। সরকার কি তা হলে সাংবাদিকদের তথা গণমাধ্যমের কোনো প্রয়োজনীয়তা আর অনুভব করছে না! সরকার আর সাংবাদিকদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হোক- সেটা কি সরকার নিজেও চাচ্ছে! সচিবালয়ে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক, মানসিক নির্যাতন, থানায় সোপর্দ করা, মামলা দায়ের এবং সর্বশেষ জামিন না দিয়ে জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়ার মধ্যে সুস্পষ্ট একটা বার্তা আছে। এটি কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার ক্ষোভের বিষয় হলে ব্যাপারটা এতোটা গড়াতে পারতো না। কথায় কথা আসছে। প্রশ্ন সামনে আসছে। কী এমন গোপনীয় তথ্য এই কর্মকর্তার টেবিলে ছিল, যা প্রকাশ হলে কার কী ক্ষতিগ্রস্ত হতো। উন্নতি বা দুর্নীতির কোন মহাপরিকল্পনার ফাইল সেখানে রক্ষিত ছিল যেটি রোজিনার হস্তগত হওয়ায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার ওপর হামলে পড়েছে?
রোজিনা সত্যি সত্যি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের ভাষ্যমতো কোনো গোপনীয় নথি ‘চুরি’ করে থাকলে তারা তাকে আটকে রাখতে পারেন না, হেনস্তা করতে পারেন না। সচিবালয়ে সারাক্ষণ পুলিশ থাকে। তারা পুলিশ ডাকতে পারতেন। পুলিশ আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেবে। তা না করে দীর্ঘ সময় সচিবালয়ে তাকে আটকে রেখে শারীরিক, মানসিকভাবে নিগৃহীত করে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে দলবদ্ধভাবে রাষ্ট্রের একজন নাগরিকের সাথে মাস্তানি করেছেন, নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। রোজিনাকে গলা চেপে ধরার কিছু ছবি গণমাধ্যমে এসেছে। ভাইরাল হয়ে ঘুরছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এমন প্রশ্নের ঘোরে আমাদের যেতেই হয় বঙ্গবন্ধুর কাছে। আড়ালে-আবডালে বা অফ দ্য রেকর্ডে' নয় খোলা ময়দানের ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমার কৃষকরা দুর্নীতি করে না। আমার শ্রমিকরা দুর্নীতি করে না। তাহলে কে ঘুষ খায়?... বিদেশে টাকা পাচার করে কে? ‘আমি জানি না এত চোর কোথা হতে আসলো! পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে, রেখে গেছে এই সব চোরের দল। তারা এই সব চোরদেরও যদি নিয়ে যেত, তাহলে আমরা আরো ভালো থাকতাম। কিছু দালাল দেশ ছেড়ে চলে গেছে। চোরেরা যদি তাদের সাথে চলে যেত, আমরাও অনেক ভালো থাকতাম।... শুধু আইন দ্বারা দুর্নীতি বন্ধ করা যাবে না।...
আজও কতো প্রাসঙ্গিক বঙ্গবন্ধুর সেই মেঠো বক্তৃতা! তার উত্তরাধিকারে সরকার গণমাধ্যমবিরোধী তা মোটেই বলা যাবে না। এছাড়া গণমাধ্যম বা সাংবাদিকতামুক্ত দেশ আজকের বিশ্বে ভাবাও যায় না। দেশের সব পত্রিকা বা টেলিভিশন বন্ধ হয়ে গেছে। কোথাও কোনো দুর্নীতির খবর নেই, ধর্ষণের খবর নেই, শিক্ষাঙ্গনের দুর্দশার খবর নেই, লুটপাট-রাহাজানির খবর নেই, শ্রমিক সংকটের খবর নেই, কোনো বৈষম্যের খবর নেই, করোনাকালীন কোনো মৃত্যুর খবর নেই। কোথাও কিছু বলার নেই, লেখার নেই। পৃথিবীর কোনো তথ্য নেই। -এমন হীরক রাজার দেশ পাগলেও ভাবে না।
Advertisement
এইচআর/জেআইএম