মনিরা নাজমী জাহান
Advertisement
সম্প্রতি আফগানিস্থান থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের যে সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে তা পুরো বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।বিশ্বের সকল মোড়ল রাষ্ট্র এই বিষয়ে তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বিশ্ব রাজনীতির সকল রথী-মহারথীরা এই সৈন্য প্রত্যাহার কে ঘিরে বিভিন্ন প্রকার রাজনীতির জটিল হিসাব কষছেন।এই সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে খোদ মার্কিন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছে তীব্র মতভেদ।বিভক্ত হয়ে পড়ছে মার্কিন বুদ্ধিজীবী সমাজ। কেন বিশ্ব রাজনীতিতে এই বিভক্তি ? কেন বিশ্ব মোড়লদের মধ্যে এই মতভেদ ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আলোকপাত করতে হবে মার্কিন –আফগান সম্পর্কের ইতিহাসের দিকে।
১৯৭৯ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল সহ দেশের অন্যান্য অংশের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। সেই সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদরা বিদ্রোহ করে বসে।তৎকালীন সময়ে ওসামা বিন লাদেনের মত কিছু আরব নাগরিক সোভিয়েত আধিপত্যের বিরুদ্ধে জিহাদের নামে আফগান মুজাহিদদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে।ওই সময়ে মার্কিনীদের প্রতক্ষ্য সাহায্যে দিন দিন আফগান মুজাহিদরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আফগানিস্তানের মুজাহিদদের আমেরিকার সাহায্যের অন্যতম কারণ ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভীতি।এই সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতেই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে আমেরিকা তৈরি করে তালেবান নামক বাহিনীকে।এক সময় তালেবানরা আমেরিকার প্রতক্ষ্য সহায়তায় আফগানিস্থানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আধিপত্য রুখতে সক্ষম হয়।এমনকি এই আমেরিকা কাঁধে নিয়ে উৎক্ষেপণ করে বিমান ধ্বংস করার মত স্ট্রিংগার নামক ক্ষেপণাস্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য আফগান মুজাহিদদের সরবরাহ করে। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই আমেরিকার মদদে গড়া বাহিনী আমেরিকার রিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে সোভিয়েত ইউনিয়নকে তাড়াতে যে তালেবানি শক্তির উত্থান আমেরিকা ঘটিয়েছিল সেই তালেবানি শক্তি ই আমেরিকার জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের টুইনটাওয়ারে ২০০১ সালে সন্ত্রাসী হামলা চালায় আল-কায়েদা আর আল-কায়েদাকে আফগানিস্থানে মদদ দেয় আফগান তালেবান রা। সেই হামলার পর ওই বছর ই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ নামে আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে অভিযান চালায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখানে উল্লেখ্য যে আফগানিস্থানে চালানো অভিযান ছিল দেশের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ইতিহাসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দ্বিতীয় দীর্ঘতম যুদ্ধ।
এই কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে তালেবান রা আমেরিকার মদদে শক্তিমান হয়ে ওঠে পরবর্তী তালেবানেরা তাদের অর্জিত শক্তি সেই আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ব্যবহার করে। আমেরিকার ইতিহাসে মোট ৪ জন প্রেসিডেন্ট এই তালেবান শক্তির বিরুদ্ধে তাদের লড়াই অব্যাহত রাখে। প্রেসিডেন্টরা হলেন জুনিয়র বুশ,বারাক ওবামা,ট্রাম্প এবং জো বাইডেন। তবে ট্রাম্পের আমল থেকে মার্কিনীরা এই যুদ্ধ নিয়ে নতুন করে ভাবতে থাকে। এই যুদ্ধের ব্যয় মার্কিন সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। যে তালেবানদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে আফগান আক্রমণ করেছিল মার্কিন বাহিনী সেই তালেবানদের সাথে কাতারের দোহায় শান্তি আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় মার্কিন সরকার।ট্রাম্পের পর জো বাইডেন নতুন সরকার গঠনের পর মার্কিন সরকার সৈন্য প্রত্যাহারের চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়।
Advertisement
প্রায় দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে আমেরিকাকেও দিতে হয়েছে চড়া মূল্য। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাবমতে, ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে অন্তত এক লাখ মার্কিন সেনা ছিল, যাদের পেছনে ব্যয় হয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার। পরে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযানে নিজেদের সেনা পাঠানোর বদলে আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলে ব্যয় বেশ কমে আসে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালে তাদের বার্ষিক ব্যয় ছিল ৪০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব থেকে জানা যায়, এ বছর ব্যয় হয়েছে ৩৮ বিলিয়ন ডলার।যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের হিসাবমতে, ২০০১ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন প্রশাসনের সামরিক ব্যয় হয়েছে ৭৭৮ বিলিয়ন ডলার। এর সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি এবং অন্য সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও ৪৪ বিলিয়ন ডলার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় করেছে।সব মিলিয়ে ২০০১ সালে আফগান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ৮২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের ঘাঁটি হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করলেও সেখানকার ব্যয় ধরা হয়নি এই হিসাবে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির যুদ্ধ প্রকল্পের ব্যয় বা “কস্ট অব ওয়্যার” প্রজেক্ট নামে এক গবেষণায় দাবি করা হয়, আফগান যুদ্ধে ব্যয়ের যে সরকারি হিসাব দেখানো হয়েছে তা প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের জন্য মার্কিন কংগ্রেস এক ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল অনুমোদন করেছিল। এতো চড়া মূল্য পরিশোধ করেও মার্কিন বাহিনী খুব একটা সুবিধা তো করতে পারিনি বরং কিছু ক্ষেত্রে নাস্তানা বুদ হয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট কর্তৃক প্রকাশিত এক মার্কিন গোপন নথিতে দেখা যায় যে , মার্কিন উচ্চ পদস্থ কর্মকরতারা স্বীকার করেন আফগানিস্থান যুদ্ধে তাদের কৌশলগত ভুল ছিল এবং আফগানিস্থানকে একটি আধুনিক রাস্ত্রে রুপান্তর করতে গিয়ে তাদের বহু অর্থের অপচয় ঘটেছে। আফগানে মার্কিন বাহিনী সুবিধা করতে না পারার অন্যতম কারন ছিল তালেবান জঙ্গিদের "এট্রিশন' পদ্ধতি প্রয়োগ। সন্ত্রাসবাদের বিভিন্ন কলাকৌশল ও পদ্ধতির মধ্যে অন্যতম হল "এট্রিশন'"।যার প্রায়োগিক অর্থ হচ্ছে ক্রমাগত প্রতিপক্ষকে আক্রমন করা, হতে পারে সেই আক্রমণটি ছোট পরিসরে তবুও আক্রমণটি চালিয়ে যাওয়া । এই ক্রমাগত আক্রমনের ফলে প্রতিপক্ষের আর্থিক অবস্থা চাপের মুখে পরে এবং সৈনিকদের ও মনোবল ভেঙ্গে যায়। এই কৌশল অবলম্বনের কারনে সামরিক ও অর্থনৈতিক, উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী তালেবানদের সঙ্গে পেরে উঠতে পারেনি।যার ফলে মার্কিন সরকার বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হয়।
তবে মার্কিন সরকারের এই রহস্যময় পিছটানের কারনে নিঃসন্দেহে দেশটি আরেকটি গৃহ যুদ্ধের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।মার্কিন সরকার অনেকটা ইচ্ছা কৃত ভাবে এমন দুই বিপরীত মুখী দল কে এমন অবস্থায় রেখে যাচ্ছে যেখান থেকে আসলে তাদের সহ-অবস্থান অনেকাংশেই অসম্ভব। জেনে শুনে মার্কিনিরা আফগানিস্তান কে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং এই কাজটি ও তারা করেছে বেশ পরিকল্পনা মাফিক। এই পরিকল্পনার সুত্র ধরে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি এক অস্পষ্ট এবং অবাস্তব চুক্তি করে। যে চুক্তিতে ইচ্ছে করেই অনেক বিষয় অস্পষ্ট এবং উহ্য রাখা হয়।উদাহরণ স্বরুপঃ মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার পরবর্তী সময়ে আফগানিস্তানের শাসনপদ্ধতি কেমন হবে, বিশেষ করে চুক্তি অনুসারে ন্যাটোর সেনা প্রত্যাহার করা হলে, তখন কাবুলের বর্তমান সরকারের ক্ষমতার পরিধি কেমন হবে সেই বিষয়ে স্পষ্টভাবে চুক্তিতে কিছু বলা নেই। বরং এই চুক্তিতে কিছুটা ছাড় পেয়েছে তালেবান জঙ্গিরা।কারণ চুক্তির শর্ত অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদনের পর আফগান সরকারকে ৫০০০ তালেবান জঙ্গিকে মুক্তি দিতে হবে।
বর্তমান আফগান সরকার বিশ্বাস করে গনতন্ত্রে অপরদিকে তালেবান বিশ্বাস করে শরিয়া আইনে।নারী নেতৃত্ব ও নারী শিক্ষা নিয়ে আফগান সরকার ও তালেবানদের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মুখী। সম্পূর্ণ ভিন্ন মানসিকতা এবং দুই বিপরীতমুখী আদর্শে বিশ্বাসী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোন ধরনের সম্পর্ক বা সমঝোতা কিভাবে হবে তার রূপ রেখা চুক্তিতে না থাকার ফলে এই চুক্তির আদৌ কোন মূল্য থাকছে কিনা সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে!
এই বিষয়টি স্পষ্ট যে মার্কিন বাহিনীর রহস্যময় প্রস্থানের ফলে আফগানিস্তান আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে আগাচ্ছে। তবে এই পিছটান কি শুধুই যুদ্ধের ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে নাকি আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে আফগানকে আবার জঙ্গিবাদের চারণভূমি বানিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে আধিপত্যবাদের নতুন পরিকল্পনার অংশ তা সময় ই বলে দিবে।
Advertisement
লেখক : শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম