ইসলামের শেষ যুদ্ধ ‘হুনাইন’। আরবদের সঙ্গে বদর প্রান্তরে শুরু হয়েছিল যুদ্ধ। আর হুনাইন বিজয়ের মাধ্যমে আরববিশ্বে ইসলামের বিজয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলামের ইতিহাসে হুনাইনের যুদ্ধের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এ যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পর সমগ্র আরব ভূখণ্ড ইসলামের পতাকা তলে চলে আসে।
Advertisement
অষ্টম হিজরির কথা। শাওয়াল মাসের ৫ তারিখে এ যুদ্ধের সূত্রপাত হয়। ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদরের মতো এ অভিযানেও মহান আল্লাহ তাআলা ফেরেশতা দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে অদৃশ্যভাবে সাহায্য করেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ বলেন-ثُمَّ أَنَزلَ اللّهُ سَكِينَتَهُ عَلَى رَسُولِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَأَنزَلَ جُنُودًا لَّمْ تَرَوْهَا وَعذَّبَ الَّذِينَ كَفَرُواْ وَذَلِكَ جَزَاء الْكَافِرِينَ‘তারপর আল্লাহ নিজের পক্ষ থেকে তাঁর রাসুল ও মুমিনদের প্রতি সান্ত্বনা নাজিল করেন এবং অবতীর্ণ করেন এমন সেনাবাহিনী যাদের তোমরা দেখতে পাওনি। আর শাস্তি প্রদান করেন কাফেরদের এবং এটি হল কাফেরদের কর্মফল।’ (সুরা তাওবাহ : আয়াত ২৬)
মক্কা বিজয়ের পর হাওয়াজিন গোত্র মক্কা থেকে তায়েফ পর্যন্ত বিস্তৃত তার শাখা গোত্রগুলোকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে একত্র করে। ৪ হাজার সৈন্যবাহিনীর পাশাপাশি সেনানায়ক মালিক বিন আউফ পূর্ণ শক্তির সঙ্গে রণাঙ্গনে তাদের সুদৃঢ় রাখার জন্য কৌশল হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে সবার পরিবার-পরিজন ও নিজেদের সহায়-সম্পত্তিও উপস্থিত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করে। উদ্দেশ্য হলো, কেউ যেন পরিবার-পরিজন ও সহায়-সম্পদের টানে রণক্ষেত্র ত্যাগ না করে।
হুনাইন যুদ্ধে পরিবার-পরিজনসহ তাদের মোট সংখ্যা ছিল ২৪ থেকে ২৮ হাজার। অন্যদিকে মুসলমানদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৪ হাজার। এদের মধ্যে কয়েক শ ছিল নওমুসলিম। সংখ্যার আধিক্য দেখে কোনো কোনো মুসলিম সেনা উৎসাহের আতিশয্যে এ দাবি করে বসেন যে আজ আমাদের জয় অনিবার্য, পরাজয় অসম্ভব।
Advertisement
কিন্তু এতে মুসলিমদের অহংকারী মনোভাব প্রকাশ পায়। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদের এ মনোভাব খুবই অপছন্দ করেন।
যার ফলশ্রুতিতে আল্লাহর হুকুমে মুসলমানরা প্রথমে বিপর্যস্ত হয়ে যায়। ৮০ থেকে ১০০ জন সাহাবি ছাড়া সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দৃঢ়তা, সাহসিকতা ও আল্লাহর গায়েবি সাহায্যে মুসলমানরা চূড়ান্ত জয় লাভ করে।
আল্লাহ তাআলার হিকমতের দাবিও ছিল এটি যে, আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের পোশাক কেবল বিনয়ীদের উপরই অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন-وَنُرِيدُ أَنْ نَمُنَّ عَلَى الَّذِينَ اسْتُضْعِفُوا فِي الأرْضِ وَنَجْعَلَهُمْ أَئِمَّةً وَنَجْعَلَهُمُ الْوَارِثِينَ وَنُمَكِّنَ لَهُمْ فِي الأرْضِ وَنُرِيَ فِرْعَوْنَ وَهَامَانَ وَجُنُودَهُمَا مِنْهُمْ مَا كَانُوا يَحْذَرُونَ‘পৃথিবীতে যাদেরকে দুর্বল বিবেচনা করা হয়েছিল, আমার ইচ্ছা হল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করার, তাদেরকে নেতা করার এবং তাদেরকে জমিনের উত্তরাধিকারী করার এবং তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় আসীন করার এবং ফেরাউন, হামান ও তাদের সৈন্যবাহিনীকে তা দেখিয়ে দেয়ার, যা তারা সেই দুর্বল দলের তরফ থেকে আশঙ্কা করত।’ (সুরা কাসাস : আয়াত ৫-৬)
বদরের যুদ্ধের মাধ্যমে আরবদের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং হুনাইনের যুদ্ধের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। এই উভয় যুদ্ধেই ফেরেস্তাগণ মুসলমানদের পক্ষে স্বশরীরে যুদ্ধ করেছেন। উভয়টিতেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শত্রুদেরকে লক্ষ্য করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন। আর উভয় যুদ্ধেই আরবরা হিংসার আগুনে নির্বাপিত হয়েছে। বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের পর তাদের অন্তরে ভয় ঢুকে পড়েছিল এবং তাদের তেজ কমে গিয়েছিল। আর হুনাইন যুদ্ধ তাদের শক্তিকে খর্ব করে দিয়েছে।
Advertisement
হুনাইনের এ যুদ্ধ ছিল হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার অনুসারী রাদিয়াল্লাহু আনহুম কর্তৃক বেদুঈন গোত্র হাওয়াজিন ও তার উপশাখা সাকিফ এর বিরুদ্ধে।
মক্কা থেকে তায়েফের পথে একটি রাস্তায তথা হুনাইন উপত্যকায় ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে লড়াইকৃত একটি যুদ্ধ। মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে যুদ্ধটি সমাপ্ত হয়। এ যুদ্ধে অসংখ্য গণিমতের মাল পায় মুসলিম বাহিনী। সূরা তওবা তে এই যুদ্ধের উল্লেখ আছে, যা কুরআনে উল্লেখিত স্বল্পসংখ্যক যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম।
এই হুনাইন হচ্ছে মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী একটি উপত্যকা। এখানেই এই ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুসলমানরা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে সামনে আসা মাত্র দুশমনরা আশ-পাশের পাহাড় থেকে এলোমেলোভাবে তীর নিক্ষেপ করতে শুরু করে।
অথচ মুসলিম বাহিনী এ পরিস্থিতির জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। এর ফলে তাদের সৈন্যদলে বিশৃংখলা দেখা দিলো এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা ময়দান ত্যাগ করে। অনেক বেদুইন গোত্র ময়দান থেকে পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে সবেমাত্র ঈমান এনেছে এবং পূর্ণ প্রশিক্ষণ পায়নি এমন অনেক নও-মুসলিমও ছিলো।
এই বিশৃংখল পরিস্থিতিতে হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত দৃঢ়তা ও প্রশান্ত চিত্তে যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং দুশমনদের মোকাবিলা করা ও ময়দান থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন না করার জন্যে মুসলমানদের প্রতি ক্রমাগত আহবান জানাতে লাগলেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার চারপাশে বহু সাহাবির এ অপূর্ব ধৈর্য, সহাবস্থান ও বীরদর্প অকৃত্রিম দৃড়তা দেখে মুসলিম সৈন্যরা পুনরায় ময়দানে আসতে শুরু করে। নবতর উৎসাহ-উদ্দীপনা ও শৌর্য-বীর্যের সঙ্গে দুশমনদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুসলিম বাহিনী।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার সাহাবিদের এই ধৈর্য ও দৃঢ়তাকেই আল্লাহ তা’আলা তাঁর তরফ থেকে অবতীর্ণ সান্ত্বনা ও প্রশান্তির লক্ষণ বলে উল্লেখ করেছেন। এর ফলে আল্লাহর অনুগ্রহে অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। আর মুসলমানরা পুরোপুরি জয়লাভ করে। কাফেরদের প্রায় ৭০ ব্যক্তি নিহত এবং হাজারেরও বেশি লোক বন্দী হয়।
কাফেরদের বাকি সৈন্যদের পালিয়ে গিয়ে তায়েফে আশ্রয় গ্রহণ করে। কারণ সে সময় তায়েফকে একটি নিরাপদ স্থান মনে করা হতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পেছনে পেছনে তায়েফ গেলেন এবং তায়েফ অবরোধ করলেন।
তয়েফে সে সময় একটি প্রসিদ্ধ ও মজবুত দুর্গ ছিলো। এর ভেতরেই কাফেররা আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো। এ অবরোধ প্রায় ২০ দিন অব্যাহত থাকে। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বুঝতে পারলেন যে, দুশমনদের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়েছে আর তাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো কোনো আশংকা নেই, তখন তিনি অবরোধ তুলে নেন এবং তাদের জন্যে দোয়া করলেন-‘হে আল্লাহ! সাকীফ গোত্রকে সুপথ প্রদর্শন করো এবং তাদেরকে আমার কাছে হাযির হবার তাওফিক দাও।’
হুনাইনের যুদ্ধে মুসলিমদের শিক্ষাইসলামের শেষ যুদ্ধ থেকে মুসলমানদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যা মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই জরুরি। তাহলো-১. মুসলমানদের কোনো অবস্থায়ই শক্তি-সামর্থ্য ও সংখ্যাধিক্যের ওপর আত্মম্ভরিতা বা গর্ভ করা ঠিক নয়। সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় যেমন তাদের দৃষ্টি আল্লাহর সাহায্যের প্রতি নিবদ্ধ থাকবে ঠিক সব শক্তি-সামর্থ্য থাকাবস্থায়ও আল্লাহর ওপর সমান ভরসা রাখতে হবে।
২. দেশ রক্ষার প্রয়োজনে অমুসলিম নাগরিকদের সহযোগিতা গ্রহণ করা বৈধ। কেননা হুনাইন যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে মক্কার বিজিত কাফিরদের থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমরাস্ত্র ধারস্বরূপ নিয়েছিলেন। পরে তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে সেসব তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হুনাইন গমনকালে ‘খাইফে বনি কেনানা’ নামক স্থান সম্পর্কে বলেছিলেন, আগামীকাল আমাদের অবস্থান হবে সেখানে। যেখানে মক্কার কুরাইশরা মুসলমানদের একঘরে করে রাখার প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছিল। এতে মুসলমানদের প্রতি যে বিশেষ হেদায়েত আছে, তা হলো শক্তি-সামর্থ্য হয়ে গেলেও বিগত বিপদের কথা ভুলে না যাওয়া। বরং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত।
৪. যুদ্ধের শেষ লগ্নে কাফেররা দুর্গে আশ্রয় নিয়ে মুসলমানদের প্রতি বাণ নিক্ষেপ করেছিল। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জন্য বদদোয়া না করে হেদায়েতের দোয়া করেন। এতে এই শিক্ষা রয়েছে যে ইসলামের যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্য শত্রুদের হত্যা বা পরাভূত করা নয়, বরং উদ্দেশ্য হলো তাদের হেদায়েতের পথে নিয়ে আসা।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইসলামের শেষ যুদ্ধ ও আরববিশ্ব বিজয়ের এ ঘটনা থেকে কল্যাণ ও উপকারিতা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। ইসলামের ওপর অটল ও অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস