মতামত

গাছ কাটা বিতর্ক এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রীর ঘোষণা

সাইফুর রহমান তপন

Advertisement

সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে গাছ কাটা ‘আপাতত বন্ধ’ ঘোষণা করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ১১ মে এ ঘোষণা দেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে যে-মেগা প্রকল্পের অধীনে গাছ কাটা কাজ চলছিল সেটি প্রণয়ন করেছে তাঁর মন্ত্রণালয়, যদিও তা বাস্তবায়ন করছে পূর্ত মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে, ‘ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প’। এটাকে সংক্ষেপে বলা হচ্ছে স্বাধীনতা কমপ্লেক্স। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। আগামী বছরের জুনের মধ্যে তা শেষ হওয়ার কথা।

মন্ত্রী শুধু গাছ কাটা বন্ধ করেননি, প্রকল্প প্রণয়নের আগে তিনি যে প্রকল্পের জায়গাটি সরেজমিন পরিদর্শন করেননি তার জন্যও ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন, যার তুলনা আমাদের সরকারের ইতিহাসে তো বটেই রাজনৈতিক ইতিহাসেও খুব কম আছে। ১১ মে মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, ‘প্রয়োজনে নকশারও পরিবর্তন করা হতে পারে। আমি নিজে সরেজমিন পরিদর্শন করবো এবং পরিবেশবিদদের সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবো। এছাড়া এ বিষয়ে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।’

Advertisement

সরকারি একটা পদক্ষেপ সম্পর্কে জনমনে সৃষ্ট প্রশ্ন নিরসনে সরকার যে এত দ্রুত এগিয়ে আসল তার জন্য তাকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হয়।

সরকার খুব সহজেই ওই গাছ কাটার প্রতিবাদকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির কাজ বলে উড়িয়ে দিতে পারত। সেই সুযোগ তার ছিল। কারণ যেসব শক্তি এ ইস্যুটিকে ঘিরে, বিশেষ করে মাঠে, বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেছিল তাদেও মধ্যে ওরাও ছিল যারা যে-কোনো উছিলায় এবং যে-কোনো উপায়ে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জনমনে যে আবেগ আছে তাও তারাÑধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে হলেওÑ ধংস করতে চায়।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল। সে হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তির সমর্থন পেয়ে আসছে দলটি। সরকার চাইলে তাকে পুঁজি করে গায়ের জোরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে ফেলতে পারত। কিন্তু সে পথে না হেঁটে সরকার প্রকল্পটি সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করেছে। এটাই একটা জনবান্ধব সরকারের বৈশিষ্ট্য।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কিন্তু গতানুগতিক কায়দায় তাদেও কাজের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু করেছিল। প্রকল্প পরিচালক এমনকি সচিব পর্যন্ত গাছকাটার প্রতিবাদকে উড়িয়ে দিয়ে এর মধ্যে এক ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজতে লেগে যান। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী নিজে যেখানে স্বীকার করেছেন যে, প্রকল্পের জায়গায় ৫০ টি গাছ কাটা হয়েছে, আরও ৫০ টি গাছ কাটা হতে পারে, সেখানে প্রকল্প পরিচালক বলেছেন, মাত্র ৪/৫ টি গাছ নাকি কাটা হয়েছে। শুধু তা নয়, প্রতিবাদকারীরা বলেছেন, যেসব গাছ কাটা হয়েছে সেগুলো অন্তত ৫০ বছর বয়সী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতেও তেমনটা দেখা গেছে। আর প্রকল্পসংশ্লিষ্ট লোকেরা বলেছেন, যা কাটা হয়েছে তা নাকি বকুল গাছ।

Advertisement

তাদেরকে যদি এসব বয়ান নিয়ে এগিয়ে যেতে দেওয়া হতো তাহলে তা নিঃসন্দেহে এক জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারত, যা সামাল দেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হতো। এ কথা বলার কারণ হল, ইট-বালি-সিমেন্টের জঙ্গল বলে পরিচিত এ ঢাকা শহরে ওপেন স্পেস বা উন্মুক্ত স্থান বলতে যা বোঝায় তার পরিমাণ খুবই কম। নগরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তেমনই একটি স্থান। প্রতিদিন হাজার হাজার লোক সকালে-বিকালে এখানে আসে একটু বুক ভরে শ্বাস নিতে, হাঁটাহাঁটি করে স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে। প্রকল্পটির পরিধি ও ধরন সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, তাতে এ মানুষগুলোর কোনো স্থান নেই। স্বাভাবিকভাবেই, এঁরা প্রকল্পটি ঠেকাতে উঠেপড়ে লাগতেন, আর অন্যদিকে সরকারও নিজেদের সুপ্রিমেসি দেখাতে প্রকল্পটি রক্ষায় যা-ইচ্ছা-তা করার চেষ্টা করত। ফলে একটা দক্ষযজ্ঞ বেঁধে যেতে পারত।

এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলেও সরকারের ত্বরিত গতিতে গাছ কাটা বন্ধ এবং প্রকল্প পর্যালোচনার ঘোষণাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেটি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত। এ প্রকল্পের সাথে গোটা জাতির আবেগ-অনুভূতি জড়িত। এখানেই বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চেও ভাষণ দিয়েছিলেন ১৯৭১ সালে, যে-ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণার সমান মর্যাদা দেওয়া হয়। আবার এখানেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি পরাজয় মেনে আত্মসমর্পণ করেছিল ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর। অর্থাৎ বলা যায়, কার্যত, এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, আবার এখানেই তা শেষ হয়েছিল। মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে জাগিয়ে রাখার জন্য তাই এ স্থানের কোনো বিকল্প নেই।

কিন্তু যে-প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল তা কতটুকু এ লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতো তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রথমত, আমাদের জানা মতে, এ প্রকল্পের নকশা করেছে সরকারের স্থাপত্য অধিদপ্তর। তার পর তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা আরও কিছু মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা নিজেরা আলোচনা করে প্রকল্প চূড়ান্ত করেছেন। এর সাথে প্রকল্পের মূল অংশীজন যে-জনগণ তার কোনো যোগ নেই। দ্বিতীয়ত, লোকালয়ে বা লোকালয়ের বাইরে যে-কোনো প্রকল্প চূড়ান্ত করার আগে তার পরিবেশ-প্রতিবেশগত প্রভাব সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ ‘নিরপেক্ষ’ কোনো সংস্থা দ্বারা যাচাই করে নিতে হয়। এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে বলে জানা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার্থে গৃহীত প্রকল্পটি প্রণয়নের সময় এর প্রণেতারা যে এসব পরিবেশ-প্রতিবেশ সমীক্ষার ধার ধারেননি তা আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় এটা দেখলে যে, সামান্য ওয়াকওয়ে তৈরির জন্য তাঁরা এ গাছগুলো কেটেছেন। ভাবা যায়! যেখানে হাইওয়ে নির্মাণ করতে গিয়ে আজকাল গাছ বাঁচিয়ে নক্সা করা হয় সেখানে একটা উদ্যানের ভেতর ওয়াকওয়ে বানাতে গিয়েÑ যেখানে শুধু মানুষ হাঁটবে, কোনোধরনের যানবাহন যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক চলাচল করবে নাÑ কয়েক ডজন গাছ কাটা হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে তখন বলা হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গনÑ পুরো এলাকা জুড়ে একটা সংস্কৃতি বলয় গড়ে তোলা হবে। মানুষ সে-ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছিল। আবার স্বাধীনতা কমপ্লেক্স নির্মাণ করতে গিয়ে আজকে যখন বলা হচ্ছে, ‘রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে দেশের ইতিহাস ও বাঙালি জাতির আবেগের জীবন্ত দলিল। সেভাবেই গড়ে তোলা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ স্থাপনাগুলো। পরিবেশ, প্রকৃতি ও ইতিহাসকে সমুন্নত রেখে নবরূপে গড়ে তোলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান হবে জীবন্ত ইতিহাস। এখানে এলেই একজন মানুষের চোখের ফুটে উঠবে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান ও লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা।’ সেটাকেও মানুষ স্বাগত জানায়।

তবে যেটা তারা একটু বাড়তি প্রত্যাশা করে তা হল, এই সব কিছুই যেন করা হয় তাদেরকে সাথে নিয়ে। মাননীয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীও তেমনটাই চান বলে আমাদের ধারণা। তিনি যে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে প্রয়োজনে প্রকল্পের নকশা পরিবর্তনেরও ঘোষণা দিয়েছেন তা আলোর মুখ দেখুক আমরা তা-ই চাই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।

এইচআর/এএসএম