জাগো জবস

শিক্ষকদের দেখে বিসিএসের স্বপ্ন জাগে মিজানের

গাজী মিজানুর রহমানের জন্ম ১৯৯০ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলায়। বাবা গাজী সিরাজুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী। মা গাজী ফাতেমা বেগম গৃহিণী। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু গ্রামের স্কুলে। ২০০৬ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মিয়াবাজার এল এন হাই স্কুল থেকে এসএসসি, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ থেকে ২০০৮ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

Advertisement

সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক সাজেদুর আবেদীন শান্ত—

জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?গাজী মিজানুর রহমান: ছোটবেলায় প্রচুর খেলাধুলা করতাম। পড়ার চেয়ে খেলাধুলায় সময় বেশি ব্যয় করতাম। তার জন্য বাসায় প্রচুর বকাবকি এবং মাঝেমধ্যে উত্তম-মধ্যমও খেতে হতো বড় ভাইয়া ও ফুফুর হাতে। মা তেমন উত্তম-মধ্যম না দিলেও মাঝেমধ্যে বকাবকি করতেন; খেলার ব্যাট-বল আগুনে পুড়িয়ে দিতেন। ছোটবেলায় আমি খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছিলাম। পরিচিত ছাড়া কারও সাথে তেমন মেশা হতো না। দেখা গেছে, হাই স্কুলে কোনো এক বেঞ্চের কোণায় চুপচাপ বসে থাকতাম। পড়া পারলেও ক্লাসে খুব একটা পড়া বলতে চাইতাম না।

জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?গাজী মিজানুর রহমান: আমার পড়াশোনায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল, আমি প্রাইমারি স্কুল লাইফে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়তাম। ফলে আমি অন্যদের চেয়ে পড়াশোনায় অনেক পিছিয়ে যেতাম। এ নিয়ে মাঝেমধ্যে অনেক মন খারাপ হতো। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যেত। এরপর প্রতিবন্ধকতা যদি বলি, মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে সব সময় কিছুটা হলেও অর্থিক টানাপোড়েন তো ছিলই।

Advertisement

জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?গাজী মিজানুর রহমান: যখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হই; আমাদের যারা ক্লাস নিতেন তারা সবাই ছিলেন বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার। তাদের দেখে ও তাদের মুখে বিসিএস সম্পর্কে শুনে প্রথমে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন জাগে মনে। তারপর যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই, অনেক স্যার বিসিএস সম্পর্কে বলতেন। তখন বিসিএস নিয়ে স্বপ্ন ডানা মেলতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় ও হলের বড় ভাইদের বিসিএস ক্যাডার হতে দেখে স্বপ্নটাকে বাস্তবে রূপ দিতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—গাজী মিজানুর রহমান: মূলত অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ থেকে একাডেমিক পড়ার ফাঁকে বিসিএসের কিছু বই নাড়াচাড়া শুরু করি। অনার্স তৃতীয় বর্ষের শেষদিকে পুরোদমে প্রস্তুতি শুরু করি। অল্প অল্প করে ম্যাথ আর ইংরেজি দিয়ে শুরু করি। যেহেতু গ্রামের স্কুলে পড়েছিলাম, তাই ম্যাথ-ইংরেজিতে দুর্বলতা ছিল। এরপর অন্য বিষয়গুলো পড়া শুরু করি। যেহেতু ইংরেজি সমার্থক শব্দ ও প্রতিশব্দ, সর্বনাম—এ জাতীয় টপিকগুলো বেশি মনে থাকতো না। তাই এগুলো অল্প অল্প করে নিয়মিত লিখে লিখে পড়তাম। নিয়মিত পত্রিকার সম্পাদকীয় ও আন্তর্জাতিক অংশ পড়তাম। যদিও আমার স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হওয়া; কিন্তু আমি আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মজীবন শুরু করি পূবালী ব্যাংক লিমিটেডে ‘সিনিয়র অফিসার’ হিসেবে। স্নাতক পরীক্ষা শেষে অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেটের মাধ্যমে ৩৪তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। জীবনের প্রথম বিসিএসেই প্রিলি, রিটেন ও ভাইভা পাস করলেও কোনো ক্যাডার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হইনি। ৩৪তম বিসিএসে পিএসসি কর্তৃক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির পদ হওয়ায় যোগদান করিনি। কারণ রেজাল্ট দিতে দেরি হওয়ায় আমি এরই মাঝে পূবালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করে ফেলি। ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হলে পূবালী ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিসিএস ক্যাডার হিসেবে যোগদান করি। এরপর ৩৬ ও ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও চূড়ান্তভাবে কোনো ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হইনি; নন-ক্যাডারের তালিকায় নাম আসে। তারপর ৩৮তম বিসিএস প্রিলিতে উত্তীর্ণ হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ট্রেনিংয়ে থাকার কারণে রিটেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ৪০তম বিসিএস প্রিলিতে উত্তীর্ণ হলেও রিটেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার আর ইচ্ছে জাগেনি। ৪০তম বিসিএসের মাধ্যমে বিসিএস যাত্রার ইতি টানি।

জাগো নিউজ: কততম বিসিএসের কোন ক্যাডারে আছেন?গাজী মিজানুর রহমান: ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত হই। বর্তমানে কুমিল্লার লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে কর্মরত আছি।

জাগো নিউজ: বিসিএসের প্রস্তুতি কেমন নিতে হয়? ভাইভার ধরন সম্পর্কে যদি বলতেন—গাজী মিজানুর রহমান: বিসিএস প্রস্তুতি একদম বেসিক থেকে শুরু করতে হয়। কারও বেসিক যদি দুর্বল হয়, তাহলে বিসিএস পরীক্ষায় ভালো করতে পারবে না। বিসিএস পরীক্ষায় যেহেতু প্রধান ধাপ তিনটি। যথা- প্রিলি, রিটেন ও ভাইভা। যার বেসিক ভালো থাকবে না, সে বিসিএসে যেকোনো ধাপে ঝরে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই কারও যদি কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকে, আগে সেই বিষয়গুলোর কনসেপ্ট ক্লিয়ার করে একদম বেসিক থেকে পড়া উচিত। কঠিন বিষয় অল্প অল্প করে লিখে লিখে হালকা শব্দ করে পড়লে বেশি মনে থাকে। পাশাপাশি নিয়মিত পত্রিকার সম্পাদকীয় ও আন্তর্জাতিক অংশ পড়া উচিত।

Advertisement

বিসিএস যেহেতু একটি দীর্ঘমেয়াদী পরীক্ষা এবং ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত যতবার সার্কুলার দেয়; ততবার পরীক্ষা দেওয়া যায়। তাই বিসিএস পরীক্ষায় কয়েকবার ব্যর্থ হলেও হতাশ হওয়া যাবে না। ধৈর্য ধারণ করে প্রস্তুতি চালিয়ে যেতে হবে। আর বিসিএস ভাইভার প্রশ্নের সম্পর্কে যদি বলি, ভাইভায় সব প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে দিতে হবে বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। মূলত ভাইভায় একজন বিসিএস ক্যাডার প্রত্যাশীর দৃষ্টিভঙ্গি, পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার দক্ষতা এবং দেশ-বিদেশ সম্পর্কে জানার পরিধি যাচাই করা হয়। ভাইভার জন্য বাংলা, ইংরেজি দুই মাধ্যমেই প্রস্তুতি নেওয়া ভালো। কারণ ভাইভায় দুই মাধ্যমেই প্রশ্ন হতে পারে। ভাইভার জন্য নিজের অনার্স-মাস্টার্সে পঠিত বিষয়, নিজ জেলা-উপজেলা, বাংলাদেশের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমসাময়িক ঘটনা থেকে প্রশ্ন করে বেশি।

জাগো নিউজ: কারও কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?গাজী মিজানুর রহমান: বড় কিছু হওয়ার জন্য আমি ছোটবেলায় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি দাদার কাছ থেকে। তিনি যখন মাঝেমধ্যে বাইসাইকেলের পেছনে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন, তখন যারা বড় বড় চাকরি করতেন তাদের নাম ধরে গল্প করতেন আর আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন, ‘জীবনে বড় কিছু করতে না পড়লে মানুষের কাজ করতে হবে। মানুষের ধমক শুনতে হবে কাজ খারাপ করলে।’ এরপর সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি নিন্দুকদের কাছে। কারণ নিন্দুকেরা সমালোচনা না করলে নিজের ভেতরের সুপ্ত শক্তিমত্তা ও যোগ্যতা এত সহজে জেগে উঠত না। নিন্দুকদের সমালোচনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে জেদে পরিণত করতে পারলে জীবনে অনেক ভালো কিছু করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।

জাগো নিউজ: আপনি যে চাকরি-প্রত্যাশীদের জন্য বই লেখেন, এ লেখালেখির আইডিয়াটা মাথায় এলো কীভাবে?গাজী মিজানুর রহমান: বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে দেখলাম, বাজারের প্রচলিত অধিকাংশ বই অগোছালো। ফলে কোনো একটি বিষয়ে প্রস্তুতি নিতে গেলে ২-৩টি প্রকাশনীর বই মিলিয়ে পড়তে হতো। কখনো কখনো নিজেকে সেই টপিকের ওপর নোট করে পড়তে হতো। নোট করার সময় ভাবতাম, জীবনে কখনো বিসিএস ক্যাডার হতে পারলে নোটগুলো দিয়ে একটি বই বানিয়ে প্রকাশ করব। এরপর যখন পূবালী ব্যাংকে চাকরি অবস্থায় বিসিএস প্রিলির প্রস্তুতি নিতে শুরু করি; তখন পড়ার জন্য বেশি সময় পেতাম না। মূলত নিজের আগের নোট ও গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো রিভিশন দেওয়ার চেষ্টা করতাম। তখন মাথায় আইডিয়া এলো, বিসিএস প্রিলির জন্য সব কিছু না পড়ে কেবল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বারবার পড়লেই প্রিলি পাস করা সম্ভব। কারণ প্রিলি পাস করার জন্য ২০০ নম্বরে ১৮০ বা ১৯০ নম্বরে পেতে হয় না। যেকোনো প্রশ্নে ১২০ নম্বর পেলেই ‘সেফ জোন’। সেই আইডিয়া থেকেই কেবল গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো নিয়ে সাজেশন আকারে ‘বিসিএস প্রিলিমিনারি অ্যানালাইসিস’ বইটি লেখা।

জাগো নিউজ: একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?গাজী মিজানুর রহমান: অনেক পরিকল্পনা আছে। ক্যারিয়ার প্রত্যাশীদের নিয়ে ভালো কিছু করতে চাই। বাজারে এখন আমার লেখা ‘বিসিএস প্রিলিমিনারি অ্যানালাইসিস’, ‘বিসিএস রিয়াল মডেল টেস্ট’, ‘প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ অ্যানালাইসিস’ এবং ‘অথেনটিক মডেল টেস্ট অ্যান্ড শর্ট সাজেশন’ বইগুলো আছে। ভবিষ্যতে বিসিএস প্রিলির জন্য প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদা বই বের করার পরিকল্পনা আছে। স্বপ্ন দেখি, একদিন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন একজন কর্মকর্তা হবো, যাতে জাতীয় শিক্ষানীতি ও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইতিবাচক ও কর্মমুখী পরিবর্তন আনতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারি।

জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?গাজী মিজানুর রহমান: আমার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ আছে। পাশাপাশি ক্যারিয়ার প্রত্যাশীদের চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য অনেকগুলো গ্রুপ আছে। সেখানে চলমান করোনা দুর্যোগে পড়াশোনার বিষয়ে অনেক পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ ছাড়া করোনো সংক্রমণ এড়াতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সচেতনতা তৈরি ও উৎসাহ প্রদান করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। করোনা সংকটে অনেকে আর্থিক সমস্যায় পড়েছেন। আমি আমার জায়াগা থেকে সামর্থের মধ্যে যতটুকু পারছি, সহযোগিতা করে যাচ্ছি।

এসইউ/জিকেএস