‘টানা ২৫ দিন অজ্ঞান ছিলাম। ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল। প্রায় মাল্টি-অর্গ্যান ফেলিয়োর হওয়ার মতো অবস্থা। আমি বেঁচে আছি বোঝাতে চিকিৎসকেরা চোখের নিচে চাপ দিতেন। তাতেই বহু রোগী চোখের পাতা নাড়ান।’
Advertisement
কথাগুলো বলছিলেন, ৬৬ বছর বয়সী এক ভারতীয় চিকিৎসক। তিনি ও তার স্ত্রী সুনন্দা দেশটির ইএম বাইপাসের একটি আবাসনে থাকেন।
‘ভিডিওকলে ওভাবে আমার চোখের পাতা নড়তে দেখলে বাড়িতে একা থাকা স্ত্রী বুঝতে পারতেন, আমি বেঁচে আছি। তবে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই ছাড়িনি। করোনাকে হারিয়েই ফিরেছি। আমার মতো ৬৬ বছরের একজন ফিরতে পারলে, আরও বহু মানুষ পারবেন।’
তিনি বলেন, বিয়ের পর থেকে মেয়ে সুইজারল্যান্ডে থাকেন। ছেলে ব্যাংকের চাকরি নিয়ে ভারতে পুণেতে। সরকারি হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসক হিসেবে আমার কর্মজীবন চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বিস্তৃত। সুনন্দা পেশায় স্থপতি। ২০১৯-এ অবসর নেয়ার পরেও আমি রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট হিসেবে এসএসকেএম হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। সেই কাজ করতে করতেই জানুয়ারিতে হঠাৎ জ্বরে পড়ি।
Advertisement
‘১২ জানুয়ারি আমার অবস্থা খুব খারাপ হয়। দ্রুত ভর্তি করানো হয় বেলেঘাটা আইডিতে। সেই সময়ের কথা এখন আর মনে নেই। শুনেছি, আমি শ্বাস নিতে পারছিলাম না। জ্ঞানও ছিল না। প্রথম দিন থেকেই ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল আমাকে। যাবতীয় পরীক্ষার পরে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিলেন, এভাবে বাঁচানো কঠিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দ্রুত একমো (এক্সট্রা-কর্পোরিয়াল মেমব্রেন অক্সিজেনেশন) থেরাপির প্রয়োজন। অর্থাৎ, আমার হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুস কোনো কাজ করতে পারছে না। যন্ত্রের সাহায্যে কাজ চালানো হবে। সেই সঙ্গে শরীর থেকে রক্ত বার করে তাতে অক্সিজেন ভরে ফের শরীরে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’
‘শুনেছি, সেই সময়ে কলকাতা মেডিকেল কলেজে একমো যন্ত্র থাকলেও সেটি কাজ করছিল না। স্বাস্থ্য ভবন এবং এসএসকেএমের অধিকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে তাই দ্রুত আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ইএম বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে।’
তিনি বলেন, সেখানেই টানা ১৭ দিন একমো থেরাপি চলেছে আমার। অবস্থা এমন হয়েছিল যে, সব কোষ ভেঙে গিয়েছিল। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলে ‘সাইটোকাইন ঝড়’। পাশাপাশি, রক্ত টেনে অক্সিজেন ভরে ফের শরীরে ঢোকানোর কাজ চলেছে। লেগেছে প্রায় ৪০ বোতল রক্ত। দিতে হয়েছে প্লাজমাও।’
Advertisement
‘২৫ দিন বাদে যখন জ্ঞান ফিরল, তখন শুরু হলো অক্সিজেন নিয়ে ভয়। তবু মনকে বোঝালাম, সমস্যায় পড়লেই অক্সিজেন পাওয়া যাবে। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম, আমি সেরে ওঠব। এক মাস লড়াইয়ের পরে সত্যিই ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে আসতে পারলাম।’
বলেন, ‘পয়লা মার্চ আমার ছুটি হলো হাসপাতাল থেকে। তবে বাড়িতে আসার পরেও প্রতিদিন ছয় ঘণ্টা করে অক্সিজেন, চারবার করে নেবুলাইজার দিতে হয়েছে। হাসপাতালের একটা শয্যা বাড়িতেই বসাতে হয়েছে। সঙ্গে চলেছে ফিজওয়োথেরাপি। শারীরিক দুর্বলতা থাকলেও এখন আমি অনেকটাই সুস্থ। শুধু দু’পায়ের গোড়ালিতে একটু ব্যথা রয়েছে।’
‘চিকিৎসক হিসেবে রোগের সঙ্গে লড়ার পথগুলো জানতাম। কিন্তু সেই পথ দিয়ে নিজেই হেঁটে এসে এখন মনে হচ্ছে, করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াই একেবারেই অসম নয়। ঠিক সময়ে ঠিক চিকিৎসা শুরুই আসল। সঙ্গে চাই মনের জোর। চিকিৎসক হিসেবে এমনিই বহু ফোন আসে, কী করব জানতে চেয়ে।’
তিনি বলেন, এখন সেটা আরও বেড়ে গেছে। বুধবার রাতেই এক জনের একমো থেরাপি করানোর দরকার ছিল। যেখানে আমার ওই চিকিৎসা হয়েছে, সেখানে খোঁজ নিয়ে শুনলাম, এই মুহূর্তে ২৩টি একমো চলছে। আশা করি, তারাও ভাইরাসকে হারিয়ে ফিরে আসবেন।
অনেকেই ফোন করছেন, করোনাকে হারিয়ে আমার ফিরে আসার গল্প শুনবেন বলে। আপনারাও তৈরি হোন, এই লড়াইয়ে জেতার গল্প শোনানোর জন্য। সূত্র: আনন্দবাজার।
এমআরএম/এমএস