মতামত

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ছিলেন আলোর ফেরিওয়ালা

এক বছর হয়ে গেল জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান আমাদের ছেড়ে গেছেন। গত বছর ১৪ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তার প্রয়াগ যেমন বেদনার, তেমনি করোনাকালে তাকে যেভাবে প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় সমাহিত করা হয়েছে সেটাও বড় কষ্টের। দেশজুড়ে তার এত অগণন প্রিয়জন কিন্তু শেষ দেখার সুযোগ পর্যন্ত ঘটলো না কারো।

Advertisement

১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি তার জন্ম। সে হিসাবে মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। বলা যায় পরিণত বয়সেই তিনি চলে গেলেন। কিন্তু তার মৃত্যু আমাদের জাতীয় জীবনে এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, যেটা প্রকৃত অর্থেই সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আনিস স্যারের পেশা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বাইরেও নানা কর্মকাণ্ডে তিনি এমনভাবে জড়িত ছিলেন যে, এক পর্যায়ে তিনি কার্যত জাতির অভিভাবকে পরিণত হয়েছিলেন। যারা তার সরাসরি ছাত্র ছিলেন না, এমন অনেকেও তাকে শিক্ষক হিসেবেই মান্য করেন। যারা তার সান্নিধ্যে এসেছেন কিংবা তার লেখা পড়েছেন, তারাই সমৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি ছিলেন আলোর ফেরিওয়ালা। পঠন-পাঠনের মধ্য দিয়ে তিনি কেবল নিজে ঋদ্ধ হননি, তার ব্রত ছিল সাধ্যমতো অন্যদেরও আলোকিত করা।

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে আনিসুজ্জামান নিজের চলার পথ তৈরি করেছিলেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ওই বয়সেই পুস্তিকা রচনা করে নিজের পরিণতমনষ্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি তৎকালীন অসাম্প্রদায়িক সংগঠন যুবলীগের দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ওই ১৫ বছর বয়সেই। যুবলীগের নেতারাই মূলত ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক দলে যোগ না দিলেও তার কাজের ধারা ছিল সমাজ ও রাজনীতির পরিমণ্ডল ঘিরেই। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ছিল প্রত্যক্ষ। স্বাধীন বাংলাদেশেও সব গণতন্ত্রমুখীন, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি সামনে থেকেই ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আত্মকেন্দ্রিক জ্ঞানতাপস ছিলেন না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনে তিনি কখনও দ্বিধা করেননি।

আনিসুজ্জামান মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৫৭ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ পাস করেন। কিছুদিন বাংলা একাডেমিতে একটি গবেষণা কাজ করার পর ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম দিকে কিছু কবিতা, গান, গল্প লিখলেও তিনি গবেষণা এবং প্রবন্ধ রচনাকেই বেছে নিয়েছিলেন, নিজের পছন্দের ক্ষেত্র হিসেবে।

Advertisement

১৯৬৪ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ তার খ্যাতি ও পরিচিতির স্থায়ী ভিত তৈরি করে। তারপর বাংলা-ইংরেজি মিলিয়ে তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ এককভাবে রচনা করেছেন। আবার যৌথ রচনা কিংবা তার সম্পাদনায়ও অনেকগুলো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার সম্পাদিত কয়েকটি স্মারকগ্রন্থও পাঠক-নন্দিত হয়েছে। তার নিজের লেখা গ্রন্থসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো : মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, পুরনো বাংলা গদ্য, আমার একাত্তর, বিপুলা পৃথিবী, কাল নিরবধি ইত্যাদি। তিনি বিদেশি সাহিত্যের কিছু অনুবাদও করেছেন।

তিনি দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে অনেকগুলো সম্মানজনক পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদকসহ অনেক পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন। ভারত সরকার কর্তৃক তিনি পদ্মভূষণ পদকে সম্মানিত হয়েছেন। দুইবার পেয়েছেন আনন্দবাজার পুরস্কার। এছাড়া আরও অনেক পুরস্কার ছিল আনিস স্যারের ঝুলিতে।

গবেষণা-বহির্ভূত গণসম্পৃক্ত কাজে যদি তাকে অনেক বেশি সময় দিতে না হতো, তিনি যদি সামাজিক দায়িত্ব একটু কম পালন করতেন তাহলে আমাদের গবেষণা এবং গদ্যসাহিত্য হয়তো আরও বেশি সমৃদ্ধ হতো। কত কিছুই না করেছেন তিনি তার ৮৩ বছরের জীবনে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে আরম্ভ করে মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, বাংলাদেশের সংবিধানের বাংলা ভাষ্য তৈরি, ড. কুদরত-ই-খোদার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশনের সদস্যসহ মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে জাতীয় জীবনে এমন কোনো ছোটবড় ঘটনা নেই, যাতে আনিস স্যারের উপস্থিতি নেই।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন পূরণের জন্য তার ছিল নিরলস সাধনা। এই কাজে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা, ক্ষেত্রবিশেষে আপসকামিতা তাকে বিদ্ধ করেছে, আহত করেছে কিন্তু তিনি তার অবস্থানে অবিচল থেকেছেন। নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মের মধ্যে উদারতা ও সম্প্রীতির বার্তা প্রচারের চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক বিভাজন, ধর্মোন্মাদনা, সন্ত্রাস-সহিংসতা , মানবিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় রোধে একটি জাতীয় জাগরণের আশায় তিনি অনেককে মেলানোর কাজটিও করেছেন। কিন্তু রাজনীতি তার স্বপ্ন-কল্পনার পথে হাঁটেনি।

Advertisement

আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান ১৯৬৯ সালে। আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরেন ১৯৮৫ সালে। তিনি ঢাকা আসার পরই আমার সঙ্গে তার আলাপ-পরিচয় হয়। তার সঙ্গে কিছু সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের সুযোগও আমার হয়েছে। তিনি আমার লেখার প্রশংসা করতেন। দেখা হলে বিরস ( আমার নামের সংক্ষিপ্তরূপ) বলে হাসিমুখে সম্বোধন করে নতুন কিছু লিখছি কি না জানতে চাইতেন। তার সঙ্গে বেশ কিছু ঘরোয়া আড্ডায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তিনি যথেষ্ট কৌতুকপ্রিয় ছিলেন। তার মধ্যে সব বিষয়েই ছিল প্রবল পরিমিতিবোধ। এই পরিমিতিবোধের কারণেই তিনি তার আপাতবিরোধী মতের লোকের সঙ্গেও মিশতে পারতেন। তিনি আমাকে একদিন বলেছিলেন, তোমার বিশ্বাস যদি নড়বড়ে না হয়, তাহলে বিরুদ্ধ মতের সঙ্গে চলতে তোমার তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তিনি তার বিশ্বাস ও অঙ্গীকারের প্রতি নিষ্ঠ ও আন্তরিক ছিলেন।

স্যারের গদ্য যেমন সুখপাঠ্য, তার বাচনভঙ্গিও ছিল মনকাড়া। অনেক কঠিন কথা, জটিল কথা তিনি অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় গুছিয়ে সহজ করে বলতে পারতেন। জানাশোনায় ফাঁকিঝুকি না থাকলে প্রকাশভঙ্গি জটিল হয় না। সফল মানুষের সঙ্গে জানাশোনা হলে আমি তাদের কাছে জানতে চাই এই যে এক জীবনে এত প্রাপ্তি, তারপরও কোনো আক্ষেপ বা অনুশোচনা তার আছে কিনা। বছর দুইয়েক আগে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার অনুরোধ নিয়ে স্যারের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। নানা প্রসঙ্গ শেষে জানতে চাই, স্যারের কোনো আক্ষেপ বা অনুশোচনা আছে কিনা।

একটুও সময় না নিয়ে স্যারের জবাব ছিল : একেবারেই আক্ষেপ নেই বলি কী করে! বিরুদ্ধ পরিবেশে বসবাস করার জন্য সারাজীবনই কেটে গেল এক ধরনের ঝড়ো অবস্থায় বা দৌড়ের মধ্যে। অনেকের জন্য কাজ করতে গেলে নিজের কাজ তো একটু ক্ষতিগ্রস্ত হয়-ই। এত সভা-সমাবেশ-সংগঠন-বিবৃতিতে ব্যস্ত থাকতে না হলে নিজের গবেষণা, লেখালেখির ওপর হয়তো আরও একটু সুবিচার করা যেত।

যিনি অভিভাবক তিনি পরিবারের সবার কথাই তো ভাববেন। আনিস স্যারকে আমরা সময়-অসময়ে অনেক জ্বালিয়েছি। তার সময়টা তার মতো করে ব্যয় করার সুযোগ দিতে চাইনি। এখন তাকে হারিয়ে আমাদের অনেক দিন জ্বলতে হবে অনুতাপের জ্বালায়।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এইচআর/এমকেএইচ