আন্তর্জাতিক

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি নৃশংসতা : কতোটা নিরপেক্ষ পশ্চিমা মিডিয়া?

মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে আরবদের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার গণমাধ্যমের ‘পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ’ বরাবরই আলোচনায় থেকেছে। বেশ কিছু বছর আগে একটি সম্মেলনে বক্তাদের বেশিরভাগই বলেছিলেন, পশ্চিমা গণমাধ্যম সবসময় আরবদের বিরুদ্ধেই থাকে। ওই সম্মেলনের খবরটি ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানের অনলাইনে প্রকাশ হয়েছিল, ‘ওয়েস্টার্ন মিডিয়া অ্যাগেইনস্ট আরব’ শিরোনামে। সেই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মার্ক লাইন্স বলেছিলেন, ‘৯/১১-এর পর অনেক আমেরিকানই আরব মিডিয়া দেখেন না বা পড়েন না...আরব ও আমেরিকানদের বৈশ্বিক পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে বিরাট ফাঁকা জায়গা আছে...আমাদের সত্যিকারের আলোচনা দরকার। আমেরিকানদের দরকার আরব মিডিয়া শোনা বা দেখা এবং বিপরীতভাবে আরবদেরও উচিত আমেরিকান মিডিয়া শোনা বা দেখা’।

Advertisement

বৈশ্বিক পরিস্থিতি বোঝার ক্ষেত্রে মার্ক লাইন্স ‘বিরাট ফাঁক জায়গা’র কথা বললেও সেটা যে মিডিয়াই তৈরি করে রাখে, সেটা হয়তো আর আলাদা করে বলতে চাননি। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যখনই সংকট তৈরি হয়েছে তখনই পশ্চিমা মিডিয়ার এই ‘খোলস’ খসে পড়েছে। সবশেষ গত ক’দিনে আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি সশস্ত্র পুলিশের তাণ্ডব, জেরুজালেমের শেখ জাররাহ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন এবং গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলাকে ঘিরে পশ্চিমা মিডিয়া যে ‘ফাঁকা জায়গা’ রেখে খবর প্রচার ও প্রকাশ করছে, তাতে নিন্দার রি রি পড়ে গেছে। দশকের পর দশক ধরে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিরা পশ্চিমা মিডিয়ার এই ‘প্রচার স্টাইলকে’ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন।

কী ঘটছে ফিলিস্তিনে?১৩ এপ্রিল থেকে ফিলিস্তিনে রোজা পালন করছেন সেখানকার মুসলিমরা। রোজা শুরুর সপ্তাহখানেক আগে পশ্চিম তীরে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান এক নিরীহ গাড়িচালক। এসময় সঙ্গে থাকা তার স্ত্রীও গুলিতে আহত হন। ওই ঘটনার পর ১৭ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে রকেট নিক্ষিপ্ত হয়। এরপর সেখানে ‘হামাসের লক্ষ্যবস্তুতে’ বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। বস্তুত তারপর থেকেই রোজা পালন করতে থাকা ফিলিস্তিনিদের ওপর চড়াও হয় দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী।

প্রতিবাদরত ফিলিস্তিনিদের ছত্রভঙ্গ করতে ইসরায়েলি পুলিশের অ্যাকশন

Advertisement

এখন যে নৃশংসতা-প্রাণহানি ঘটছে, তার বেশিরভাগই চলছে পূর্ব জেরুজালেমে। ১৯৬৭ সালে আরবদের সঙ্গে যুদ্ধের পর এলাকাটি দখল করে নেয় ইসরায়েল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেন। যদিও ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের একক রাজধানী হিসেবে পূর্ব জেরুজালেমকেই দেখে আসছে।

এই পূর্ব জেরুজালেমেই মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্র স্থান আল আকসার অবস্থান। এবারের রমজানের শুরু থেকেই ফিলিস্তিনের ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা এই এলাকার দামেস্ক গেটে প্রার্থনা করতে গিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর বাধার মুখে পড়েন। প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন তারা। তীব্র বিক্ষোভের মুখে ২৫ এপ্রিল দামেস্ক গেট থেকে পিছু হটে ইসরায়েলি পুলিশ

এরপর ৩ মে ইসরায়েলি বাহিনী তাদের দখলকৃত পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনি বৃদ্ধাকে গুলি করে মারে। তিনি ছুরি দিয়ে হামলা চালানোর চেষ্টা করেছেন অভিযোগ তুলে গুলি করে ইসরায়েলিরা। ওই ঘটনার তিন দিনের মাথায় তল্লাশি-অভিযানের নামে ১৬ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি কিশোরকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনারা।

আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে মুসল্লিদের সরাতে ইসরায়েলি পুলিশ অ্যাকশনে

Advertisement

তবে বড় ঘটনা ঘটে ৭ মে, জুমাতুল বিদার দিন। পশ্চিম তীর ও শেখ জাররাহ এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপনে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর উচ্ছেদের প্রতিবাদে কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি মুসল্লি পবিত্র আল-আকসা মসজিদে জমায়েত হন। বিক্ষোভ দমনে ইসরায়েলি বাহিনী জমায়েতকারীদের ওপর জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। ইফতারের ঠিক আগ মুহূর্তে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর গুলিও ছোঁড়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ইসরায়েলি বাহিনীর সদস্যরা আল-আকসা মসজিদের ভেতরেও ঢুকে পড়ে। সে ঘটনায় অন্তত ১৬৩ ফিলিস্তিনি আহত হন।

ওই ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামলে পরদিন ৮ মে রাতেও ইসরায়েলি পুলিশ ফিলিস্তিনিদের ওপর বলপ্রয়োগ করে। ১০ মে সকালে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে তাণ্ডব চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। তারা ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হন। এই সহিংসতা তারা চালাতে থাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। রাতে ইসরায়েলি দখলদারদের বর্বরতা ভিন্নমাত্রা নেয়। গাজা উপত্যকা থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের রকেট হামলার অজুহাত তুলে তারা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের বসতিতে বিমান হামলা চালায়। এতে বুধবার (১২ মে) ভোর পর্যন্ত ৩২ ফিলিস্তিনির প্রাণ হারানোর খবর মিলেছে। যাদের মধ্যে ১০ শিশু এবং এক নারীও রয়েছেন।

সেই ঘটনার প্রবাহ আরও উদ্বেগজনক মোড় নিতে চলেছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।

পশ্চিমা মিডিয়ায় ঘটনা যেভাবে আসছেরোজার মধ্যে নিরীহ-নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের এই বর্বরোচিত আচরণের খবর প্রায় সব সংবাদমাধ্যমই প্রচার করছে। তবে ‘প্রচার স্টাইল’র কারণে পশ্চিমা মিডিয়াকেই দাঁড়াতে হচ্ছে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের অভিযোগের কাঠগড়ায়। তারা বলছেন, দখলদারিত্ব, গুলি করে হত্যা, গুলিবর্ষণ এবং বোমা হামলার মতো ঘটনায় ‘ক্ল্যাশ’ (সংঘর্ষ), ‘কনফ্লিক্ট’ (সংঘাত) ও ‘প্রোপার্টি ডিসপুট’র (সম্পত্তি বিরোধ) মতো শব্দের ব্যবহার আগ্রাসনবাদী শক্তির শক্তিপ্রয়োগকে আড়াল করে ফেলে। এ ধরনের ‘প্যাসিভ ভয়েস’র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সহিংসতার ‘কারণ’ বা ‘টার্গেট’ চেপে যাওয়া হয়।

ইসরায়েলি পুলিশকে শাসাচ্ছেন এক ফিলিস্তিনি

সেজন্য ফিলিস্তিনি ও তাদের প্রতি সংহতি জানানো বিদেশি বন্ধুরা অনেক পশ্চিমা গণমাধ্যমেরই খবরের ‘স্ক্রিনশট’ নিয়ে সেখানে তাদের মতে ‘যথাযথ শব্দ’ বসিয়েছেন এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

যেমন পশ্চিম তীর ও শেখ জাররাহ এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপনে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর উচ্ছেদের প্রতিবাদে বিক্ষোভ এবং সেখানে অস্ত্রপ্রয়োগের ঘটনা ঘটলেও যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ তাদের অনলাইনে প্রচারিত খবরের শিরোনাম করেছে, ‘এভিকশন্স ইন জেরুজালেম বিকাম ফোকাস অব ইসরায়েলি-প্যালেস্টিনিয়ান কনফ্লিক্ট’, যার অর্থ দাঁড়ায় ‘ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে জেরুজালেমে উচ্ছেদ’।

এই শিরোনামে ‘ইসরায়েলি’ শব্দের অর্থ স্বাভাবিকভাবে ‘বেসামরিক ইসরায়েলি’কেই বোঝাবে, অথচ এই ঘটনার পক্ষ ‘সশস্ত্র পুলিশের সদস্যরা’। আবার যে ‘এভিকশন্স’ বা ‘উচ্ছেদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে তা ইসরায়েলি নাকি ফিলিস্তিনিরা চালাচ্ছে, তা স্পষ্ট হয় না। অথচ বছরের পর বছর ধরে ফিলিস্তিনি বসতি উচ্ছেদ করে ইহুদি বসতি গড়ে চলেছে ইসরায়েলি বাহিনী।

আহত এক ফিলিস্তিনিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে

এই শিরোনামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা ‘এভিকশন্স’ কেটে তার বদলে ‘ফোর্স এক্সপালসন’ বসিয়েছেন। কেটে দিয়েছেন ‘ইসরায়েলি’। ‘কনফ্লিক্ট’ কেটে বসানো হয়েছে ‘স্ট্রাগল। যাতে পুরো বাক্য দাঁড়াচ্ছে ‘ফোর্স এক্সপালসন ইন জেরুজালেম বিকাম ফোকাস অব প্যালেস্টিনিয়ান স্ট্রাগল’, অর্থাৎ জেরুজালেমে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে।

৭-৮ মে রাতে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী গুলি-কাঁদানে গ্যাস-সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করলেও ৯ মে ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম করা হয় ‘মোর দ্যান ৯০ প্যালেস্টিনিয়ানস ইনজুরড আফটার অ্যানাদার নাইট অব ক্ল্যাশেস ইন জেরুজালেম’, যার অর্থ দাঁড়ায় `জেরুজালেমে আরেক সংঘর্ষের রাতে ৯০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত’।

ফিলিস্তিনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, ‘ক্ল্যাশ’ সাধারণত দুটি পক্ষের মধ্যে হয়। যেখানে সংঘাতে জড়ানো দু’পক্ষের ওপরই সমান দায় চাপানোর সুযোগ থাকে, এই শব্দ সচরাচর সেখানে ব্যবহার হয়ে থাকে। নিরস্ত্র মুসল্লিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী আগ্নেয়াস্ত্র-সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে ‘অ্যাটাক’ বা আক্রমণ করলেও ‘ক্ল্যাশ’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের অপরাধ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কেবল তা-ই নয়, এই শিরোনামে ‘ইন জেরুজালেম’ বলা হলেও সংঘর্ষের কাদের মধ্যে হয়েছে তা স্পষ্ট করা হয়নি। ইসরায়েলকেই শিরোনামে এড়িয়ে গিয়ে কেবল ফিলিস্তিনি আহত বলা হয়েছে। জেরুজালেমের সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন না, এমন কেউ এই শিরোনাম পড়ে যদি মনে করেন, জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে, তবে তাকে ভুল সাব্যস্ত করার সুযোগ কম। পাঠককে বিভ্রান্ত করার এমন হীন চেষ্টাই আছে এই শিরোনামে।

ফিলিস্তিনি কিশোর-তরুণদের তল্লাশি করছে ইসরায়েলি পুলিশ

ফ্রান্সভিত্তিক বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদ সংস্থা এএফপির এ সংক্রান্ত সংবাদের প্রচার স্টাইলও অসন্তোষ ছড়িয়েছে ফিলিস্তিনি পাঠকদের মধ্যে। কয়েকদিনের ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরে টুইটারে ১ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ছেড়েছে তারা, যেখানে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, ‘প্যালেস্টিনিয়ান প্রটেস্টার্স অ্যান্ড ইসরায়েলি সিকিউরিটি ফোর্সেস ক্ল্যাশ, ওয়াটার ক্যানন ডেপ্লয়েড। প্যালেস্টিনিয়ান প্রটেস্টার্স অ্যান্ড ইসরায়েলি সিকিউরিটি ফোর্সেস ক্ল্যাশ ইন ইস্ট জেরুজালেম, অ্যাজ টেনশন বয়েল ওভার দ্য পোস্টপোনমেন্ট অব অ্যা কি কোর্ট হিয়ারিং অন অ্যা ফ্ল্যাশপয়েন্ট প্রোপার্টি ডিসপুট’। যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ, জলকামান মোতায়েন। সম্পত্তি বিরোধ নিয়ে একটি আলোচিত শুনানি স্থগিত হওয়াকে ঘিরে উত্তেজনা বাড়ছেই, পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ।’

ফিলিস্তিনি সামাজিক যোগোযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, শেখ জাররাহ এলাকায় ইহুদি বসতি স্থাপনে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর উচ্ছেদের প্রতিবাদকে ঘিরে ঘটনার বর্ণনায় ‘প্রোপার্টি ডিসপুট’ বললে হয়তো একভাবে মনে হতে পারে ঠিক আছে। কিন্তু এর মাধ্যমে অর্ন্তনিহিত প্রেক্ষাপটকে মারাত্মকভাবে চেপে যাওয়া যায়। বরং এই শব্দ যুগলের মাধ্যমে বোঝানো হতে পারে যে, শেখ জাররাহ এলাকায় যা ঘটছে তা প্যারিস, লন্ডন বা ইস্তাম্বুলের জমির মালিক ও ভোগদখলকারীর বিরোধের চেয়ে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণও নয়, কিংবা ওই তিন শহরের সম্পত্তি বিরোধের চেয়ে খুব বড় নৈতিক বিতর্কেরও ব্যাপার নয়।

কিন্তু পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জাররাহর ঘটনা এতো সরল নয়। সেখানকার যে ৪০ ফিলিস্তিনি উচ্ছেদের শিকার, তাদের পরিবার বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইসরায়েল থেকে ১৯৫৬ সালে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছিল। তখন পূর্ব জেরুজালেম ছিল জর্দানের নিয়ন্ত্রণে। শেখ জাররাহতে তখন তাদের ঘর করে দিয়েছিল জাতিসংঘ রিফিউজি ওয়ার্কস এজেন্সি। ১৯৬০ সালে ওই পরিবারগুলোর সঙ্গে জর্দান সরকারের একটি চুক্তি হয়, যার মাধ্যমে জমিতে তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধের পর পূর্ব জেরুজালেম ইসরায়েল দখলে নিয়ে সেই চুক্তি বাতিল করে দেয়। তখন ইসরায়েল এমন আইন করে, যেখানে ১৯৪৮ সালের আগে ওই এলাকায় বাস করা ইহুদি বাসিন্দাদের সম্পত্তিতে মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বিপরীতদিকে, ফিলিস্তিনি যারা ১৯৪৮ সালের আগে থেকে ওই এলাকায় বাস করছিলেন, তাদের মালিকানা নাকচ করে দেয়া হয়। আগ্রাসনের নানা কায়দা-কানুনে পরিস্থিতি এতোদূর আসার পর সেটাকে কেবলই ‘সম্পত্তি বিরোধ’ বলার মধ্য দিয়ে সাধারণ আইনি ইস্যুর চেয়েও খাটো হিসাবে দেখানো হয়।

এএফপির টুইটারে প্রচারিত খবর

নিউইয়র্ক টাইমস, স্কাই নিউজ এবং এএফপি বা তাদের সমমনা অন্য মিডিয়াগুলো শিরোনাম তৈরিতে বা শব্দের ব্যবহারে এমন চাতুর্য দেখালেও এদের অনুকরণকারী কিংবা এদের কাছ থেকে ভাষান্তরকারী ভিনদেশের মিডিয়াগুলোর কেউ কেউ হয়তো অজ্ঞাতসারে বা অসচেতনতাবশতই একই স্টাইলে খবর প্রচার করেছে।

তবে হাস্যকর কাণ্ড ঘটিয়েছে নিউইয়র্ক পোস্ট। ১০ মে রাতে গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা হলে সে খবরটি নিজেদের টুইটার পেজে প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্রের এ ট্যাবলয়েড দৈনিক। কিন্তু ইসরায়েলের চালানো বিমান হামলায় ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি হলেও নিউইয়র্ক পোস্টের খবরে বলা হয়, ‘হামাসের চালানো বিমান হামলায় ইসরায়েলে ২০ জন নিহত হয়েছেন’। এ নিয়ে উপহাস-বিদ্রুপের পাশাপাশি সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এটিকে ইচ্ছেকৃত ভুল নয় বলে জোর দাবি করারও সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করছেন অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী। নিউইয়র্ক পোস্টের এ ভুল নিয়ে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও খবর প্রচার হয়।

প্রচার স্টাইলে দ্বিচারিতা?আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি বাহিনীর তাণ্ডবের কথা না লিখলেও এই নিউইয়র্ক টাইমসই ২০১৩ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরের বিতর্কিত গেজি পার্কে গাছ কেটে বিপণিকেন্দ্র নির্মাণকে ঘিরে যে বিক্ষোভ-সহিংসতা হয়েছিল, তখনকার খবর প্রচারে শিরোনামে লিখেছিল ‘পুলিশ স্টর্ম পার্ক ইন ইস্তাম্বুল’ (স্টর্ম শব্দের অর্থ তাণ্ডব, অভিযান, আক্রমণ)। তাদের সমমনা বা অনুকরণকারী অন্য মিডিয়াগুলোও তখন এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতেই খবর প্রচার করেছিল।

নিউইয়র্ক পোস্টের হাস্যকর কাণ্ড

ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর গুলি, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপের বিষয়টি শিরোনামে না এলেও ২০১১ সালের ৯ জুলাই মালয়েশিয়ায় নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের বলপ্রয়োগের খবর প্রসঙ্গে তখন এপি, ফ্রান্স২৪, এনবিসি নিউজসহ পশ্চিমা মিডিয়াগুলো শিরোনামে স্পষ্ট করেই লিখেছিল, ‘বিক্ষোভে মালয়েশিয়া পুলিশের কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ, আটক ১৬০০’।

অবশ্য ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিপরীতধারায়ও দেখা গেছে পশ্চিমা কিছু মিডিয়াকে। যেমন ব্রিটেনের দুই শতাব্দীর প্রাচীন দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ ও আরেক প্রাচীন দৈনিক ‘দ্য টেলিগ্রাফ’।

যেমন ১০ মে’র ঘটনায় দ্য গার্ডিয়ানের শিরোনাম ছিল, ‘ইসরায়েলি পুলিশ স্টর্ম আল-আকসা মস্ক অ্যাহেড অব জেরুজালেম ডে মার্চ’, অর্থাৎ জেরুজালেম দিবসের পদযাত্রা কর্মসূচির আগে আল-আকসা মসজিদে ইসরায়েলি বাহিনীর হানা (তাণ্ডব, অভিযান, আক্রমণ অর্থও ব্যবহার হয়)।

১০ মে রাতে ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলার খবর প্রচারে দ্য টেলিগ্রাফের শিরোনাম ছিল, ‘ইসরায়েল লঞ্চেস ডেডলি গাজা অফেন্সিভ আফটার ৩০০ ইনজুরড ইন জেরুজালেম ক্ল্যাশেস’, অর্থাৎ জেরুজালেমে সংঘর্ষে ৩০০ জন আহত হওয়ার পর গাজায় প্রাণঘাতী আক্রমণ শুরু করেছে ইসরায়েল।

কাঠগড়ায় সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্মএদিকে ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন ইস্যুতে মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও অভিযোগের শূলে চড়াচ্ছেন প্লাটফর্মগুলোর ব্যবহারকারীরা। তারা বলছেন, ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর উচ্ছেদ করে ইহুদিদের অবৈধ বসতি স্থাপনে অপতৎপরতা প্রতিবাদ করে এবং ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় হতাহতের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শেয়ার করা পোস্ট মুছে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো।

ইস্তাম্বুলের পার্কে অভিযান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের খবরের শিরোনাম

অনেকে বলছেন, ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি সারাবিশ্ব থেকে বহু মানুষ সংহতি জানিয়ে #SaveSheikhJarrah হ্যাশট্যাগ সম্বলিত পোস্ট করছিলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। কিন্তু সেসবের মধ্যে কিছু পোস্ট মুছে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিছু ব্যবহারকারীর অ্যাকাউন্টও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি #SaveSheikhJarrah হ্যাশট্যাগ বা শেখ জাররাহর ঘটনার কোনো ছবি দিয়ে প্রতিবাদ করায় অ্যাকাউন্টের ব্যবহার সীমিত করার অভিযোগও মিলেছে।

ফিলিস্তিনের পলিসি নেটওয়ার্ক আল শাবাকার সদস্য মারওয়া ফাতাফতা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা যখন তাদের টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে, তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো উদার মানসিকতার আড়ালে কার্যত তাদের মুখ বন্ধ করে দিতে চাইছে।’

তিনি ফেসবুক, টুইটারসহ সব সামাজিক মাধ্যমের এমন আচরণ অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানান। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের স্বাধীন প্লাটফর্ম হলেও পোস্ট কেন মুছে দেয়া হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা দেয়ারও দাবি করেছেন মারওয়া ফাতাফতা।

এইচএ/এমকেএইচ