অর্থনীতি

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে ক্ষতিগ্রস্ত পোল্ট্রি

চলমান করোনা (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে সরকার ঘোষিত লকডাউনে বিপাকে পড়েছেন পোল্ট্রি খামারিরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। ফলে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের পোল্ট্রি খামারিরা। এমন পরিস্থিতিতে অনেক খামারের উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

Advertisement

পোল্ট্রি খামারিদের এই পিছিয়ে পড়ার শুরুটা গত বছর থেকে। সে সময় করোনা প্রকোপের মধ্যে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এরপর ক্ষতির মুখে পড়েন পোল্ট্রি খামারিরা। বছর শেষে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে লোকসান কাটিয়ে উঠতে শুরু করেন তারা। সামাজিক অনুষ্ঠান ও পর্যটন কেন্দ্রগুলোর বদৌলতে প্রাণ ফিরতে শুরু করে পোল্ট্রি ব্যবসায়। কিন্তু চলতি বছর করোনার ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ মোকাবিলায় এপ্রিলের ১৪ তারিখ থেকে লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এতে নতুন করে সঙ্কটে পড়েন পোল্ট্রি খামারিরা।

এর মধ্য গত বছর প্রাণিসম্পদ খাতের ক্ষতিগ্রস্ত একজন খামারিকে সর্বোচ্চ ২২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন তিন হাজার ৩৭৫ টাকা করে প্রণোদনা দেয়া হয়।

খামারিরা বলছেন, করোনার কারণে স্বাভাবিক বাজার ব্যাহত হওয়ার প্রভাব পড়ছে ব্যবসায়। করোনার অজুহাতে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে মুরগির খাবার ও বাচ্চার দাম। এতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের। সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া প্রণোদনার অর্থে ক্ষুদ্র খামারিরা সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখলেও মুরগির বাচ্চা ও খাবারে বাড়তি দাম তাতে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসগুলোকে আরও খামারিবান্ধব ও পোল্ট্রি নীতিমালা করার দাবি জানান তারা।

Advertisement

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের (বিপিকেআরজেপি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ৯৮ হাজারের বেশি পোল্ট্রি খামারি রয়েছে। এর মধ্যে করোনাকালে নানা সমস্যার কারণে ২৮ শতাংশের বেশি খামারে উৎপাদন বন্ধ। সামনে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লাল (বাদামি) ডিম ৬ টাকা ৫৫ পয়সা, সাদা ডিম ৫ টাকা ৭৫ পয়সা দরে বিক্রি করছেন পোল্ট্রি খামারিরা। ব্রয়লার মুরগি ১২০ টাকা কেজি, কালবার্ড লাল মুরগি ২১০ টাকা কেজি, কালবার্ড সাদা মুরগি ১৪০ টাকা কেজি, সোনালি মুরগি ১৯৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লেয়ার লাল বাচ্চা ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, লেয়ার সাদা বাচ্চা ২০ থেকে ২৫ টাকা ও ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা ৩০ থেকে ৩১ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

পোল্ট্রি ফিড ব্যবসায়ী সমিতির (দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান) আহ্বায়ক তৈয়ব তাহের জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার খামারে ১৫ হাজার লেয়ার, ৩০ হাজার ব্রয়লার ও ৭ হাজার সোনালি মুরগি আছে। আমাদের দীর্ঘদিন ধরে দুরবস্থা চলছে। প্রথম কথা হলো পোল্ট্রির কোনো নীতিমালা নেই। একটি নীতিমালা অনেক দিন ধরে হবে বলে কথা হচ্ছে। কিন্তু সেটি হয়নি। বর্তমান মন্ত্রী দায়িত্বে আসার পর এর উদ্যোগ নিলেও করোনার কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। নীতিমালায় মূলত বাচ্চার সর্বোচ্চ দাম, ফিডের সর্বোচ্চ দাম, মুরগির সর্বনিম্ন দাম কেমন হবে সেসব বিষয় থাকার কথা। পোল্ট্রিতে এখন অরাজক অবস্থা। মুরগির দাম বাজারে ৩ টাকা বাড়লে কোম্পানিগুলো বাচ্চার দাম ১০ টাকা বাড়িয়ে দেয়। আবার মুরগির দাম কমলে তারা বাচ্চা বিক্রি করতে পারে না। ব্রাজিলে ফিড বা ভুট্টার দাম বাড়লে এ দেশে তা আসতে লাগে দুই মাস। কিন্তু এখানে সেদিনই দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। সরকার একবার বাচ্চার সর্বোচ্চ দাম ৩৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিল, কিন্তু সেটি কেউ মানে না।’

করোনার কারণে ক্ষতির পরিমাণটা অনেক বেশি। প্রতিনিয়ত পোল্ট্রির সঙ্গে যুক্ত কেউ না কেউ আর্থিক সমস্যায় পড়ছেন বলে উল্লেখ করেন তৈয়ব তাহের। বলেন, ‘বাজারে মুরগির দাম বাড়লে অনেকেই ভাবে খামারিরা অনেক লাভ করছে। বাজারে ১৪০ টাকায় মুরগি বিক্রি হলে দেখা যাবে খামারি ১১০ টাকাও পায় না অথচ কেজিতে ব্রয়লারের উৎপাদনে ১২৫ টাকা পড়ে। আজকে গরমের কারণে মুরগি বিক্রির জন্য আড়তদারকে ফোন করলে আড়তদাররা তাৎক্ষনিক ১০ টাকা দাম কমিয়ে ফেলবে। তখন বাধ্য হয়েই খামারির বিক্রি করে ফেলতে হয়। এছাড়াও লকডাউনসহ নানা কারণে খামারিদের কম দামে মুরগি বিক্রি করতে হয়। তাই আমরা সরকারিভাবে পোল্ট্রি মার্কেট করার জন্য প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম, তাহলে মানুষ সঠিক দামে মুরগি কিনতে পারত এবং আমরাও দাম কিছুটা বেশি পেতাম।’

Advertisement

পোল্ট্রি খামারি ও পোল্ট্রির বাজার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা শিমুল হক রানা জাগো নিউকে বলেন, ‘দেশে পোল্ট্রি খামারগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক জায়গায় রোগে মুরগি মারা যাচ্ছে। অনেক লেয়ার খামারি নিঃস্ব হয়ে গেছে। খামারিদের টিকে থাকাই এখন কষ্টকর। ডিম বিক্রি করে উৎপাদন খরচই তুলতে পারছে না খামারিরা। বাজারমূল্য কম থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। লেয়ার মুরগির বাজার কিছুটা স্বাভাবিক থাকলেও ব্রয়লার মুরগি ও সোনালি মুরগির বাজারের অনেকটা ধস নেমেছে। মূলত যেসব সিন্ডিকেট রয়েছে তারা সমস্যা তৈরি করে। তারা প্রচুর পরিমাণে মুরগি উৎপাদন করছে, যখন বাজার ভালো থাকে তখন তারা প্রচুর পরিমাণে মুরগি বাজারে ছাড়ে। বড় বড় বিডা ফার্ম যাদের রয়েছে তারাই এই সিন্ডিকেটটা করে।’

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাংসের দাম যখন ১০ টাকা বাড়ে, তখন ভোক্তা পর্যায়ে অসন্তুষ্টি দেখা দেয়। প্রায় প্রতি বছরই যে সব রেমিট্যান্স যোদ্ধারা বিদেশ থেকে ফেরেন, তাদের মধ্যে ১৬ থেকে ১৭ শতাংশ এই সেক্টরে বিনিয়োগ করেন। তাদের পুঁজি একটা সময় থাকে না। বাজারে মূলত কিছু সিন্ডিকেট তাদের বাচ্চা এবং খাবারের মাধ্যমে ছোট ছোট খামারিদের শেষ পুঁজিটুকুও নিয়ে নেয়। এক্ষেত্রে এটি দেখাশোনা করতে একটি তদারকি সেল বা মূল্য নির্ধারণে সরকারিভাবে একটি কমিটি থাকার কথা, কিন্তু গত পাঁচ বছরেও সেটি নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন জনের সঙ্গে বৈঠকে বসলেও মূলত যারা ভুক্তভোগী তাদের সঙ্গে বসে না। ফলে সমস্যা সম্পর্কে তাদের জানানো যাচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘করোনাকালে মানুষ বের হতে পারে না, বাজারে যেতে পারে না। ফলে বাজারটা আগের মতো অবস্থায় নেই। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ভ্রাম্যমাণভাবে যে বিক্রির উদ্যোগ নেয়া হয়, তাতে কিছুটা উপকার হয়। তবে যে রকমটা আশা করেছিলাম সেরকম উপকার হয়নি। সরকার খামারিদের যে আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে সেটি তৃণমূলের খামারিরা পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের নেতারা মুরগির খাবারের দাম ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে খামারিদের কাছ থেকে সেই টাকা নিয়ে নিয়েছেন বলা চলে। এগুলো দেখার কেউ নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের কর মৌকুফ করা হয়েছে। যারা প্রান্তিক খামারি ডিলারের মাধ্যমে খাদ্য সংগ্রহ করে তারা এই সুবিধাটি পায় না।’

সার্বিক বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব রওনক মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পোল্ট্রি খামারিদের সহায়তার উদ্যোগ ইতোমধ্যে নেয়া হয়েছে। প্রথমত ব্যাংক থেকে তাদের লোন দেয়া হচ্ছে। এছাড়া পোল্ট্রিতে ফিডমিলের সয়াবিনের আমদানির ওপর শুল্ক মওকুফ করা হয়েছে। এসব সহায়তা অলরেডি চলছে। তার পরও আমরা পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছি এবং এই শিল্পের বিকাশ হচ্ছে। আমাদের এখন প্রচুর মুরগি ও ডিম উৎপাদন হচ্ছে। তারপরও সরকারকে আমরা বলছি তাদের যে পণ্য সামগ্রী বিদেশ থেকে আনা হয় সেটার কর যাতে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়। কর তো শতভাগ মওকুফ করা যাবে না। এছাড়া করোনার মধ্যে তাদের সমস্যা সমাধানে আমরা ভ্রাম্যমাণভাবে মুরগি-ডিম বিক্রির ব্যবস্থা করেছি। যদি কোনো সমস্যা থাকে সেগুলোও সমাধান করা হবে।

আইএইচআর/জেডএইচ/এমএস