বিশেষ প্রতিবেদন

তরুণ প্রজন্মকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে

মুসা সাদিক সাবেক সচিব। বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের রণাঙ্গন সংবাদদাতা। চাকুরিজীবনে প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নানা পট পরিবর্তনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনটি বই লিখেছেন। ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’ (বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই), ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’- গ্রন্থগুলো ইতিহাসবিদ ছাড়াও সকল শ্রেণির পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের সহকারী সম্পাদক ড. হারুন রশীদ  জাগো নিউজ : বিজয়ের মাস ডিসেম্বর শুরু হল। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এবারের ডিসেম্বরে কেমন অনুভূতি আপনার? মুসা সাদিক : যদি এক কথায় বলি তাহলে এবারের ডিসেম্বরে আমার মনে হচ্ছে একাত্তরের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটছে। কারণ যা এক সময় মনে হয়েছিল অসম্ভব তাই সত্যি হয়েছে। যে যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেয়া হয়েছিল তাদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী সাকা-মুজাহিদের ফাঁসি হল, অথচ টু শব্দটি হল না। এটা ভাবতে পারেন? অথচ ক’দিন আগেও এদের দাপটের কাছে কেউ ভিড়তে পারতো না। পরাজিত শক্তির এই আস্ফালন দেশের মানুষ ভালভাবে নেয়নি। তাই এদের দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়ে দেশ অভিশাপমুক্ত হয়েছে। একটি স্বস্তিকর অবস্থা ফিরে এসেছে। জাগো নিউজ : যুদ্ধাপরাধের বিচার হতে এত সময় লাগলো কেন?মুসা সাদিক : দেখুন একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। মুজাহিদ তখন মন্ত্রী। যশোরে একটি জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি। ঘটনাচক্রে আমি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে মুজাহিদ উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমি একাত্তরে রাজাকার ছিলাম। আপনারা সবাই দাঁড়িয়ে আমাকে সম্মান দেখান।’ তো এই দৃশ্য আমি নিজে দেখলাম। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা সহ্য করার মতো নয়। তারপরও আমাদের অনেক কিছুই দেখতে হয়েছে। ভাগ্য ভাল যে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন। তার দৃঢ় মনোবলের কারণেই এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হচ্ছে। অবশ্যই দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের সমর্থন রয়েছে এই বিচারে। কেন না এই বিচারের সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত।জাগো নিউজ : মুজাহিদ তো বলতো বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। মুসা সাদিক : মুজাহিদ এখন ইতিহাস। কেউ ভাল কাজ করে ইতিহাস হয়। কেউ খারাপ কাজ। মুজাহিদরা একাত্তরে কী করেছে তা নতুন করে বলতে চাই না। এদেশের মানুষ সব জানে। তাছাড়া আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তার সাজা হয়েছে।  একটি ঘটনার কথা বলি। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় প্রবাসে। এরপর ক্রুদ্ধ হয়ে পাকহানাদার ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর বাহিনী অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।  ২৯ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলার শেষ সীমান্ত হালুয়াঘাট থেকে পাঁচ মাইল উত্তরে বিরাট হাওড় এলাকার ওপর দিয়ে শত শত পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতের মেঘালয়ের দিকে যাচ্ছিল। তখন ঐ এলাকাটি নিরাপদ ছিল বলে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলেই দলে দলে সেখানে জড়ো হয়। পাক হানাদার বাহিনীকে পথ চিনিয়ে সেখানে নিয়ে আসে রাজাকার বাহিনী। তারা লোকজনের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকারে নৌকায় ভাসমান শত শত পরিবারের ওপর বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ করা হয়। এর মধ্যে শেরপুর বন্দরের এক ব্যবসায়ীর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ছিলেন। রাজাকারেরা তার হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে নৌকা থেকে পাড়ে তুলে নিয়ে আসে। শরীর থেকে কাপড় খুলে নেয়। সম্পূর্ণ বে-আব্রু করে ফেলা হয় তাকে। তারপর দু’তিনজন রাজাকার ওই গর্ভবতী নারীর পেটের ওপর দাঁড়িয়ে থেকে বাচ্চা বের করে ফেলে। এরপর নবজাতকের মাথা বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়। অজ্ঞান অবস্থায় প্রসূতিকেও মেরে ফেলা হয়। এ রকম পৈশাচিক ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। এরপরও সেই রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীরা দম্ভ করে! সেই জাতীয় পতাকাধারীদের এখন ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হচ্ছে। জাগো নিউজ : সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে পাকিস্তান প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ নিয়ে তারা বলেছে একাত্তরে বাংলাদেশে কোনো গণহত্যা হয়নি।মুসা সাদিক : দেখুন পাকিস্তান তো কত কিছুই বলে। অতীতেও বলেছে। ভবিষ্যতেও বলবে। আমি টিক্কা খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তিনিও বলেছেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা করেনি। তারা কিছু হিন্দু লোককে হত্যা করেছে। বিস্তারিত আমার ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’ বইয়ে আছে। রণাঙ্গণের সংবাদদাতা হিসেবে আমি নিজেই অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সত্যি বলতে কি আজকে যে আপনার সাথে আমি কথা বলছি, আমার তো বেঁচে থাকারই কথা নয়। একাত্তরের ২৯ নভেম্বর যুদ্ধের গোপন ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন কালে ৮ নং সেক্টরের চাঁচড়ায় ভারতীয় ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক জ্যোতি সিংসহ আমি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তাদের অমানুষিক নির্যাতনে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। মৃত ভেবে তারা আমাকে ফেলে রেখে যায়। সেখান থেকে ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই। এ ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আমাকে স্বীকৃতি দেয়ার কথা বলেন। তিনি এ ব্যাপারে লিখেন- ‘মুক্তিযুদ্ধে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে মুসার অপরিসীম অবদান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন হুদা যেভাবে পাকসেনাদের গোলাবৃষ্টির মধ্যে নিজের জীবনের নিরাপত্তা উপেক্ষা করে মুসার জীবন বাঁচিয়েছেন সেজন্য তাদের উভয়জনের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করার জন্য এবং তাদের কাছে জাতির ঋণ স্বীকার করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের পক্ষে আমি এখানে স্বাক্ষর করলাম।’’একাত্তরের রণাঙ্গনে সহযোদ্ধাদের সাথে মুসা সাদিক (মাঝে দাঁড়িয়ে)জাগো নিউজ : ২০২১-এ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে বর্তমান সরকার। এটা কতোটা সম্ভব বলে আপনি মনে করেন। মুসা সাদিক : দেখুন সব কিছুর মূলে আসলে নেতৃত্ব। একটা উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেছিলেন যে চীনের চেয়ে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ। তো ভারতের অর্থনীতিবিদ হিসেবে নোবেল পুরস্কার নিতে তার কেমন অনুভূতি হচ্ছে। উত্তরে অমর্ত্য সেন বলেছিলেন- ‘আমরা চীনকেও ছাড়িয়ে যেতে পারতাম যদি আমাদের শীর্ষ নেতৃত্বকে হত্যা না করা হত। এর ফলে উন্নয়নের একটি ধারাবাহিতা থাকতো।’ কথাটা ভেবে দেখুনতো। ১৯৭৫ সালে যদি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ক্ষমতায় না আসতো তাহলে দেশ আজ কোথায় যেত? সঠিক নেতৃত্ব থাকলে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকে। আর  উন্নয়নের ধারাবাহিকতা থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছানো কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। সিঙ্গাপুরের মাথাপিছু আয় ছিল এক সময় ৩২৩ ডলার। এখন ৪৯ হাজার ডলার। কোরিয়া, জাপানও এগিয়েছে সমান তালে। আমরাও এভাবে এগিয়ে যেতে পারতাম। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা এখন নেতৃত্বে। তিনি যেভাবে হাল ধরেছেন তাতে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছা কোনো অসম্ভব ব্যাপার নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ এক সময় স্বপ্ন ছিল। এখন তা বাস্তব। শেখ হাসিনার মধ্যে নেতৃত্বের যে প্রভা, উজ্জ্বলতা ও প্রখরতা দেখতে পাচ্ছি তাতে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন কিছু নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের সরকার ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতায় থাকা দরকার। যেমনটি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি সম্প্রতি বলেছেন। সত্যি বলতে কি শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এখন সারা বিশ্বেই প্রশংসিত হচ্ছে। দেশ-বিদেশের নানা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটা আমি বুঝতে পারি। ফ্রান্সের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সম্প্রতি একটি ই-মেইল পেয়েছি। তিনি ফ্রান্সের জাতীয় বীর ‘জোয়ান অব আর্কের’ সাথে শেখ হাসিনার তুলনা করেছেন। এটা একজন বাঙালি হিসেবে অবশ্যই আমাকে গৌরবান্বিত করে। জাগো নিউজ : বিভাজিত সমাজে রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া কি কাঙ্খিত উন্নয়ন, অগ্রগতি সম্ভব? মুসা সাদিক : অবশ্যই সবার সম্মিলিত প্রয়াস থাকতে হবে। যে যেখানে আছেন সেখান থেকেই তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধারা যে বাংলাদেশ চেয়েছিল সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমি যদি স্পষ্ট করে বলি তাহলে বলতে হবে প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ সবাইকে নিজ নিজ সীমানার মধ্যে থাকতে হবে। দেশমাতৃকার প্রতি অবিচল আস্থা ও দেশপ্রেম বজায় রেখে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। কোনো গাফিলতি চলবে না। দুর্নীতি চলবে না। অনিয়ম ও বৈষম্য দূর করতে হবে। এখানে তারুণদেরকে একটি ভারসাম্যমূলক ভূমিকা বজায় রাখার জন্য এদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। জাগো নিউজ : তরুণ প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অস্থির সময়ে যারা বেড়ে উঠেছে তাদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কি?মুসা সাদিক :  বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে দেয়া হয়নি। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। করা হয়েছে বিপথগামীও। আশার কথা হচ্ছে, এই তারুণ্যই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের জাগরণের মধ্য দিয়েই কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা সম্ভব হচ্ছে। আমি এই তারুণ্যের ওপর ভরসা রাখতে চাই। তাদের নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদীও আমি। তরুণ প্রজন্মকেই অতন্ত্র প্রহরী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে। দেশ গঠনেও তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। সত্যি বলতে কি তারুণ্যের ইতিবাচক ভূমিকায়ই পারে একটি দেশ বা জাতিকে এগিয়ে নিতে। আপনি যদি চীনের কথাই ধরেন সেখানে কিন্তু তরুণরা এগিয়ে এসেছে বলেই চীন আজ শুধু পরাশক্তিই নয়, অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হতে চলেছে।  মাও সেতুংয়ের মত নেতৃত্বকে একটি গতি এনে দিয়েছিল তরুণরাই। আমাদের দেশেও এটা করতে হবে। এ জন্য বিজয়ের মাসে নতুন করে শপথ নিতে হবে। জাগো নিউজ : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। মুসা সাদিক : আপনাকে এবং জাগো নিউজ পরিবারকেও ধন্যবাদ।  এইচআর/এআরএস/এমএস

Advertisement